সাপের দেবী মনসা। সাপের আছে বিষ, কাজেই সাপে ভয়ও আছে। আর এই সাপ নিয়ে কিংবদন্তিও রয়েছে অনেক। আবার দেবী মনসাকে নিয়ে যত গান আছে, আর কোনোও দেবীকে নিয়ে বা তার বাহনকে নিয়ে বোধহয় তা নেই। সেই সাপকে নিয়ে " মনসা মেলা " বাংলার গ্রামে গঞ্জে অঢেল। নাগপঞ্চমী .... শ্রাবন মাসের কৃষ্ণ পঞ্চমী অর্থাৎ পূর্ণিমার পরে যে কৃষ্ণ পক্ষ তার পঞ্চম দিন। নাগপঞ্চমীতে মনসা পূজোর রেওয়াজ রয়েছে সারা ভারতে। অনন্তনাগ, বাসুকিনাগ, শঙ্খনাগ, পদ্মনাগ---- এমন সব কত সর্পদেবীর পূজো করা হয় এদিন। গ্রীষ্মের প্রখরতা যত বাড়ে, সাপের বিষও তত বাড়ে। সাধারণত অম্ববাচীতে বৃষ্টি হয় এবং ঐ দিন থেকে সাপের বিষও কমে। বর্ষায় সাপ বেশী বের হয় বলেই এই সময় নাগপূজা হয়। গ্রাম বাংলায় বিশেষ করে নিম্নভূমি ও জলজঙ্গলের দেশ পূর্ব বঙ্গে এভাবেই কল্পিত হয়েছেন সর্পদেবী মা মনসা। ক্রমে লোকবিশ্বাস থেকে সৃষ্টি হয়েছে লোকগীতির। ফলে আমরা পেয়েছি মনসামঙ্গল কাব্য, চন্ডী মঙ্গল কাব্য প্রভৃতি। আর এভাবেই লোকবিশ্বাসের সূত্র ধরে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন গ্রামীণ মেলার।
পূরাণ কাহিনী অনুযায়ী মনসাদেবী শিবের কন্যা। শ্রাবন সঙঞান্তীতে পিতা-পুত্রী উভয়ের জন্মদিন। শ্রাবন সঙঞান্তীতে মনসাপূজো, শিব পূজো এবং খেদাঈতলার মেলার দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে সেই অতীত থেকে।
খেদাইতলার মেলার প্রাচীনতা সম্বন্ধে কারও মত, মেলার বয়স আড়াইশো বছর। মেলার অতীত কথা এরকম........ নদীয়া জেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের সাতসলাকীর মুখে দ্বি-শতাধিক বছর আগে চাচর মেলা বা হোগলার মেলা বসতো। তখন স্থানটির নাম ছিল " সাঁতরা"। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যেমন দর্শনার্থীরা আসতেন সেই মেলায় , মেলাও সেজে উঠত তেমনি আকর্ষণীয় বিভিন্ন পন্যের সম্ভারে ।
খেদাইতলায় কোনো বিগ্রহ নেই। একটি নিমগাছকেই দেবতার প্রতিভূ হিসেবে মান্য করে ভক্তরা । দুধ সহ পূজো দেন। গাছটির গোড়ায় এভাবে প্রচুর পরিমাণে দুধ উৎসর্গ করার ফলেই সম্ভবত মৃত্যু হয়েছে সেটির। ভক্তদের বিশ্বাসে তাতে কোনো পরিবর্তন হয়নি বোঝা যায় তাদের দুধ ঢালার উদ্দীপনা দেখে। মৃত নিমগাছটির জায়গায় বসানো হয়েছে অপর একটি নিমগাছকে। বিগ্রহহীন একটি পাকা ঘরের ( মন্দির) পাশে এই নিমগাছের তলায় শ্রাবণ সঙক্রান্তীতে বিশ্বাস ও ভক্তির আবেগে ভেসে পূজো দেন সহস্র সহস্র মানুষ। বহু মানুষ মানতের পাঠা বলি দেন, দন্ডি কাটেন, মানতের ঢিল বাঁধেন বিশ্বাসের কেন্দ্র ওই গাছের ডালে। এরজন্য পুরুষ ও মহিলাদের ভিন্ন ভিন্ন দীর্ঘ লাইন পড়ে। মেলায় লক্ষ লক্ষ আগতদের মধ্যে কেউ হয়তো সাপূরেদের কেরামতি দেখতে বা ছবি তুলতে ব্যস্ত, কেউ আবার দোকান থেকে তার প্রয়োজনীয় জিনিস ----- যেমন তালপাতার টোকা, মাছ ধরার জাল, জালের জন্য লোহার কাঠি, ঘূর্ণি, পোলো, খালুই, হুকো থেকে বাঁশ বেতের ধামা কুলো, ঝুড়ি-চুপড়ি, লোহার তৈরি কোদাল, খন্তা, শাবল, নিড়ানি, কুড়ুল, কাটারি, ছুরি, কাঁচি প্রভৃতি কিনতে ব্যস্ত। আর চলেছে চপ-কাটলেট, পরোটা, কচুরি, জিলাপি, আগের রস, ভাত খাওয়া দাওয়া। সব দোকানেই উপচে পড়া ভীড়।
লোকবিশ্বাস ও লোকসংস্কৃতির মধ্যে সাধারণ মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা অনুভূতি স্বত:স্ফূতভাবে প্রকাশ পায়। সমাজের সব শ্রেণীর মানুষেরই আছে বিশ্বাস আর ধর্মীয় ভাবাবেগ। আর সবকিছু ছাপিয়ে আছে মেলার আনন্দ। তাই খেলাই নামাঙ্কিত মেলায় আজও ঘটে চলেছে লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ।
শিয়ালদহ মেন লাইনের ' চাকদহ ' স্টেশনের বাইরে থেকে "বনগ্রাম" গাভী যে কোনো বাস, ট্রেকার, ভ্যান রিকশা, মোটরভ্যানে পৌঁছানো যায় খেদাইতলার মেলায়। চাকদহ-বিষ্ঞুপুর বাজার থেকে ডানদিকে পরিপূর্ণ গ্রাম্য পরিবেশে ৩ কি মি হাঁটাপথ পেরিয়ে লোকবিশ্বাস ও লোককাহিনি নির্ভর এই প্রাচীন মেলায় পৌঁছানো যায়।
 |
ছোট খেদাইতলা |
 |
মেলায় আসবাবপত্রের দোকান |
 |
লোক চলছে মেলার দিকে |
 |
পূজো দেবার ভীর |
 |
পূজোর জন্য প্রসাদের দোকান |
 |
জালের দোকান |