Thursday, 5 November 2020

পিয়াসাড়ার সরকার জমিদার বাড়ি

 

পিয়াসাড়ার সরকার জমিদার বাড়ি *"*"*"*'*"*"*"*"*"*


পিয়াসাড়া সরকার পরিবার হুগলি জেলার অন্যতম প্রাচীন জমিদার পরিবার। তাদের নবম প্রজন্ম এখন দেবী দুর্গার উপাসনার ঐতিহ্য বজায় রেখেছে। প্রায় সাড়ে তিনশত বছরের পুরনো এই পূজো। শোনা যায় ইনাদের পূর্বপুরুষ শ্রী শরৎ চন্দ্র সরকার মহাশয় প্রথম দূর্গা পূজার প্রচলন করেন। এই জমিদার বাড়ির পূর্ব পদবী খাঁ ছিল। সিরাজদৌলার আমল থেকে খাঁ নামেই পরিচিত ছিল। পরবর্তী কালে বর্ধমানের মহারাজা সরকার উপাধি দেন এবং জমিদার বলে ভূষিত করেন। 






ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় ..... এক সময় এনারা জমিদার ছিলেন বর্ধমান রাজার অধীনে। সেই সময় এই বঙশের এক জমিদার কর দিতে না পারায় বর্ধমানের রাজা ওনাকে কারাগারে বন্দী করে রাখেন। বন্দীদশায় কিছু দিন থাকার পর জমিদারবাবু অনশন শুরু করেন এই দু:কে যে তিনি না থাকলে পিয়াসারা জমিদার বাড়িতে দূর্গাপূজো হবে না। এই খবর রাজার কানে যায়। রাজা কথা বলেন জমিদারের সাথে এবং ওনাকে ছাড়েন এক শর্তে যে ফিরে  গিয়ে দূর্গা পূজো করতে হবে। তখন মাত্র পূজোর সাতদিন বাকি। ঠাকুর এক মেটে হয়ে পরে আছে। রাজামশাই সাথে একজনকে পাঠান যিনি পুরো ব্যাপারটা দেখাশোনা করবেন। তারপর জমিদার ফিরে এলেন এবং যথারীতি মহাসমারোহে দূর্গাপূজা হ'ল। জমিদারের এমন ব্যবহার দেখে রাজা তখন জমিদারি নিষ্কর ঘোষণা করলেন এবং তারপর থেকেই সরকার বাড়ি খুব ভালোভাবে জমিদারি করতে থাকেন। 






এই বাড়ীর দূর্গা ঠাকুর চার হাত বিশিষ্ট এবং একচালা, ডাকের সাজের। এই বৈশিষ্ট্যটির জন্য অন্যান্য পূজোর থেকে এটিকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে। আগে এখানে ছাগ ও মহিষ বলি হতো। এখন এগুলি উঠে গেলেও এখন ছাঁচিকুমড়ো, আখ, আদা ও লেবু বলি হয়। এছাড়া সন্ধিপূজোতে দুটি পরাতের প্রতিটিতে এক থেকে দেড় মণ চাল ও তৎসহ আনাজ ও বিভিন্ন ফল সহ মাকে নিবেদন করা হয়। বাড়ীর কুলোদেবতা নারায়ন  ও দেবী লক্ষ্মীকে পূজোর এই কটা দিন ঠাকুর দালানে আনা হয় এবং তার পর মায়ের পূজো আরম্ভ হয়। শোনাযায় অনেক আগে দূর্গা পূজার পর বাসন্তী পূজাও জমিদার বাড়িতে হতো। এখনও এ বাড়িতে গেলে নবম পুরুষের শ্রী বিশ্বনাথ সরকার বা শ্রী অশোক সরকারের মুখে সমস্ত ইতিহাস শোনা যায়।





এই সরকার বাড়ি হরিপালের কাছে। নিকটতম ল্যান্ডমার্ক  ডানকুনি-চাপাডাঙ্গার রাস্তায় গজাড় মোর। এই মোর ছাড়িয়ে একটু এগুলে গোবরহারা হাই স্কুল। এই স্কুলের ঠিক উল্টো দিকের রাস্তা যেটা পঞ্চানন পাম্পের পাশ দিয়ে গিয়েছে সেটা দিয়ে সোজা এগুলে সরকার জমিদার বাড়িতে যাওয়া যায়।






তিড়োলের খ্যাপা কালী, আরামবাগ

 

তিড়োলের খ্যাপা কালী, আরামবাগ ********

মা কালী বিভিন্ন নামে পূজিত হন। কোথাও রখ্খাকালী, কোথাও শ্যামাকালী, আবার যখন শ্মাশানে এই দেবী পূজিত হন, তখন তাঁকে শ্মাশান কালী বলে ডাকা হয়। কিন্তু তিড়োলের এই মন্দিরে কালী পূজিত হন খ্যাপাকালী নামে। কিন্তু কেন এই নাম? কথিত আছে বছরের পর বছর ধরে এই মন্দিরে এসে মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। তাই লোকমুখে ইনি হয়ে উঠেছেন " খ্যাপাকালী "।




আরামবাগের পাঁচশত বছরের প্রাচীন তিড়োলের জমিদার পরিবার। আরামবাগ শহর থেকে মাত্র ৫ কি মি দূরে বা আরামবাগ ষ্টেশন থেকে ২ কি মি দূরে এই তিড়োল গ্রাম।  ৫০০ বছর পূর্বে চক্রবর্তী জমিদার পরিবার মহাসমারোহে প্রতি বছর দূর্গা পূজা করতেন। তাদের জমিদারিতে কালী পূজোর প্রচলন ছিল না। জমিদার দীনণাথ চক্রবর্তী স্বপ্নে সিদ্ধেশ্বরী কালীর সন্ধান পান। তিনিই মহাসমারোহে সিদ্ধেশ্বরী কালীর প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর থেকেই জমিদার পরিবার দূর্গা পূজোর পরিবর্তে কালীপুজো করে আসছেন।  দীননাথ চক্রবর্তী ছিলেন অত্যন্ত সৎ -জন  এবং প্রজা দরোদি একজন জমিদার। তিনি মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠার পর এলাকার প্রচুর দু:স্থ  অভুক্ত মানুষের মধ্যে মায়ের প্রসাদ বিতরণ করতেন। 



এই মন্দিরে নিযুক্ত পুরোহিত শ্রী কাজল চক্রবর্তী মহাশয় বঙশ পরস্পরায় এই দেবীর পূজো করে আসছেন। তাঁর থেকে জানা যায় এই মন্দিরের মা নাকি খুবই জাগ্রত। মায়ের হাতের বালা যদি মানসিক রোগীকে পরানো হয় , তাহলে তিনি নাকি সুস্থ হয়ে যান। সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর মন্দিরের সামনে অবস্থিত পুকুরে স্নান করে সেই ভালো মা কে উৎসর্গ করে তামার বালা পড়াতে হয়। বহু প্রাচীনকাল থেকেই এই প্রথা চলে আসছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অগনিত মানসিক রোগী , এই আধুনিক বিজ্ঞানের যুগেও মায়ের কাছে আসেন ও সুস্থ হয়ে উঠেন ...... এরূপ শোনা যায়। 




কালী মায়ের যে বালা তৈরি করা হয় সেই বালাও তৈরি করেন এই গ্রামেরই নির্দিষ্ট এক কর্মকার পরিবার। সেই আদিকাল থেকেই মায়ের স্বপ্নাদেশ মতই ঐ কর্মকার পরিবারের সদস্যরাই একমাত্র এই বালা তৈরি করেন। বিখ্যাত সাহিত্যিক বিভুতিভূষন বন্দোপাধ্যায় " তিরোলের বালা " নামক একটা ছোট গল্পে এই প্রাচীন মায়ের অলৌকিক ক্ষমতার কথা লিখেছেন। কথিত আছে, সারদা দেবী তাঁর বৌদি মানসিক ভারসাম্য হারালে এই মায়ের স্বরনাপন্ন হয়েছিলেন এবং মায়ের কৃপায় সুস্থও হয়েছিলেন। মা সারদা দেবীর ভাইজি রাধু মুখোপাধ্যায়ও মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন এবং তাকে নিয়েও মা সারদামনি এই মায়ের পূজো দেন। মায়ের বালা পরিয়ে রাধুও সুস্থ জীবন ফিরে পেয়েছিলেন। 



প্রতি মঙ্গলবার এই খ্যাপাকালীর কাছে পশুবলি দেওয়া হয় এবং কালীপুজোর দিনেও প্রচুর পশুবলি হয়ে থাকে। সারা বছর অসঙখ্য ভক্তের ভীড় থাকলেও কালীপূজোতে সেই ভীড় বাড়ে কয়েক গুণ। কারন সেদিন সারারাত বিশেষ তিথি ধরে মায়ের পূজো হয়। এই উপলক্ষে মন্দির চত্বরে বসে মেলা, যা দেখার জন্য পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি থেকেও প্রচুর মানুষ ভিড় করেন। এই কালীপুজোর অন্যতম বিশেষত্বই হ'ল নহবতের সানাই। মায়ের স্বপ্নাদেশ ক্রমে বাঁকুড়ার কোতলপুরের গোগরা গ্রামের সানাইবাদক মন্ডল পরিবারের সদস্যরা সানাই বাজানো শুরু করেন। আজও মায়ের প্রিয় নহবত সানাই বাজানো হয় যা বঙশানুক্রমে এখনও বাজিয়ে আসেন সেই পরিবারের সদস্যরা। তাদের কিন্তু কোনো নিমন্ত্রন করা হয় না।



এই মায়ের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হ'ল ------- ধনিয়াখালির জমিদার, বিশ্বাস পরিবারের দূর্গা পূজোর পর দূর্গা মায়ের মুকুটটি প্রতি বছর কালীপুজোতে তিড়োলের সিদ্ধেশ্বরী মায়ের মাথায় স্থান পায়। মায়ের নির্দেশেই নাকি এমন ঘটনা ঘটে। ফলে এই দুই জমিদার পরিবারের মধ্যে এক সৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।




শুধু মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীই নয়, এখানে সুস্থ হয়ে উঠেন মৃগীরোগীরাও। তাই তিড়োল গ্রামের এই দেবী শুধু এলাকারই নয়, হয়ে উঠেছে গোটা রাজ্যের দেবী।