Monday, 6 December 2021

ইষ্টিকুটুম ফার্ম হাউজ

 


ইষ্টিকুটুম ফার্ম হাউজ। বেশ একটা মিষ্টি নাম। বার বার উচ্চারণ করতেও ভালো লাগে। আলিপুরদুয়ার থেকে প্রায় ২২ কি মি দূরে। গাড়ীতে ৩৫ - ৪০ মিনিটের পথ। এছাড়াও কাছের ষ্টেশন হামিলটনগঞ্জ (১২ কি মি দূরে) থেকেও  আপনি যেতে পারেন।  গাড়ীতে মিনিট  ২০ লাগতে পারে। ঠিকানা ---- উত্তর পাটকাপাড়া,  পাটকাপাড়া টি এস্টেট, আলিপুরদুয়ার।









দু চার দিনের ছুটির আমেজ কাটাতে হলে এখানে গেলে আপনার আকাঙ্খিত শান্তির খোজ পেলেও পেতে পারেন বলে আশা করি। প্রথমেই বলি নামকরনের সর্থকতা। ইষ্টিকুটুমের মানে কাঙ্খিত বা বাঞ্চিত  অতিথি। তাই ইষ্টিকুটুমকে ইচ্ছাকুটুমও বলা যেতে পারে । তবে কুটুম কার ??? আপনি এখানে যাবেন  প্রকৃতির কুটুম হয়ে। যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখতে পাবেন  "ইষ্টিকুটুম" পাখি গাছের ডালে বসে তার নিজের সুরে আপনাকে অভর্থনা জানাচ্ছে। এ পাখি দেখতে যেমন সুন্দর,  গলার আওয়াজও ততোধিক সুন্দর।  আর প্রকৃতি যেন, তার  নিস্তব্ধার ডালি নিয়ে বসে রয়েছে। চা বাগান লাগোয়া আপনার থাকবার জায়গা। প্রায় ৩০ - ৪০ পা দূরে কালজিনি নদী বয়ে চলেছে। ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছা না করলে বেড়িয়ে পড়ুন। চা বাগানের মধ্যে দিয়ে সরু রাস্তা একটু এগুলেই পেয়ে যাবেন  অজানা পাহাড় থেকে জন্ম নেওয়া কালজিনি নদী। বর্ষাকাল ছাড়া এ নদী যেন সুন্দরী মেয়ের মতো আপন মনে নাচতে নাচতে এগিয়ে চলেছে। জলে স্রোত রয়েছে সর্বত্র।  তবে সব জায়গায় স্নান করবার মতন গভীরতা নেই।  তাতে কি আছে ?? আপনি নদীতে নেমে আপনার কাপড় একটু ভেজাতে আনন্দই পাবেন। এত স্বচ্ছ জল বয়ে যেতে আপনি হয়ত কমই দেখেছেন। দূরে কোথাও আপনি দেখতে পাবেন কেউ  জাল ফেলে মাছ ধরছে বা কেউ  টানা জালে মাছ ধরছে। কাছে গিয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ করলে মাছ রাখার থলিতে মাছ  দেখাতে তারা একটুও কুন্ঠিত বোধ করবে না। দেখতে পাবেন  " বোরোলি " মাছ  , যা দেখতে ছোট হলেও স্বাদে অতুলনীয়। মনে হয় প্রকৃতি যেন একটু অবিচার করে শুধুমাত্র এসব অঞ্চলের মানুষের জন্য এই মাছ  সৃষ্টি করেছেন। 




















এবার আসি ফার্ম হাউজের কথায়। এখানে কি গাছ নেই সেটা বলাই  কঠিন।  ফুল, ফল, সবজি, শৌখিন প্রভৃতি কত রকমের  যে গাছ আছে সেগুলির সব নাম আমার দ্বারা লেখা সম্ভব হবে না। কমলালেবু, মোসুম্বি, সবেদা, কদবেল, কলা, বেল  বাতাবিলেবু, কামরাঙ্গা ছাড়াও সাধারণ গাছ যেমন খেজুর,  নারকেল, সুপাড়ি, আম, জাম, তাল, কাঠাল, বকফুল প্রভৃতি নানা ধরণের গাছে ভর্তি। রয়েছে নানা ধরনের ফুল গাছ  যা গেলেই আপনার চোখে পরবে। বাগানের মধ্যেই রয়েছে দুটি দোলনা। সেখানে ইচ্ছা করলে গান গাইতে গাইতে দোলনাই চড়তে পারেন।  পাশেই রয়েছে সবজি খেত। এদের তৈরি আলু, বেগুন,  লঙ্কা, সিম, ফুলকপি, মূলো, কড়াইশুটি ইত্যাদি আর বিভিন্ন ধরনের শাক আপনি খেতে পাবেন দুপুরে বা রাত্রের খাবার মেনুতে। শীতকালে এলে যে কোনো ধরনের সব্জি আবদার করলে আপনি পেয়ে যাবেন। পেয়ে যাবেন শীতের সকালের খেজুরের রস বা চা প্রেমিকরা পেয়ে যাবেন যতবার ইচ্ছা লিকার বা দার্জিলিঙ স্বাদের চা। কেননা এখানকার কর্মীরা আপনাকে তাদের কুটুম হিসেবেই দেখবে আর আপনার সন্তুষ্টির জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। এদের  পরিষবা  এককথায় তুলনাহীন। খেতে পাবেন  ফার্ম হাউজের পোষা গরুর দুধ বা হাসের ডিম। দেখতে পাবেন রাজহাস। আদর করে ঘাস খাওয়াতে পারবেন  খাচায় থাকা খরঘোস বা   গিনিপিককে। এখানে একটা কথা না বললে এ লেখা ত্রুটিপূর্ন হবে। সেটা হ'ল এই ফার্ম হাউজের মালিক  শ্রী সুব্রত কুন্ডু মহাশয়ের কথা।তার আতিথিয়তার কোনো মাপকাঠি নেই।  তিনি নিজে আপনার খাবার বা থাকার ব্যাপারে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা বারবার  খোঁজ নেবেন। তার ব্যক্তব্যে এটাই প্রকাশ পাবে যে আপনারা সেখানে হোটেলে থাকতে আসেননি। এসেছেন তাঁর কুটুম বা অতিথি হয়ে হোম ষ্টে-তে থাকতে। হোটেল আর এখানে থাকার মধ্যে এক বিরাট ফারাক রয়েছে। 

















রাতে রয়েছে অন্য এক উপলব্ধি। নিস্তব্ধতার আসল সংঙ্গা তখনই  খুজে পাবেন । শুনবেন ঝিঝি পোকার আওয়াজ  বা আপনার কাছের কোনো গাছেতে বসে থাকা পেঁচার ডাক। যদি আপনার  কপাল ভালো থাকে , তবে হাতির পাল জঙ্গল থেকে নদী পেরিয়ে চা বাগানের ভেতর দিয়ে ধানের জমিতে ধান খেতে আসতে দেখতে পারেন।  এতে আপনি ভয় পাবেন  না আনন্দ পাবেন সেটা আপনার নিজের ব্যাপার।  তাই  সন্ধ্যায় অন্ধকার নেমে এলে ফার্ম হাউজের সীমানার বাইরে না যাওয়াই  ভালো।



এখান থেকে বেশ কয়েকটা ছোটখাটো টুরও করে নিতে পারেন।  যেমন ----- চিলাপাতা ফরেষ্ট, জলদাপাড়া ফরেষ্ট, রায়মাটাং, টোটোপাড়া, জয়ন্তী,  বক্সা ফোর্ট, সন্ত্রাবাড়ি, খয়েরবাড়ি,  সিকিয়াঝোড়া, ভুটানঘাট, ফুনশিলিং, কোচবিহার  প্রভৃতি। এসবের ব্যবস্থা বা গাড়ির বন্দোবস্ত সুব্রত বাবুকে বললেই করে দেবেন। তাই  হাতে দু চার দিন নিয়ে আসলে এক ঢিলে অনেকগুলো পাখিই মারতে পারবেন।  এসে একবার নিজেই যাচাই করে যান  .....  শহরে থাকার একঘেয়েমি থেকে, শহরে থাকার ক্লান্তি থেকে .... সত্যিই ঐ কটা দিনের জন্য শান্তির স্বাদ পান কিনা ??





Sunday, 1 August 2021

ঝাড়গ্রাম রাজার বাড়ি

 


ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ী সম্বন্ধে দু চার কথা ::

বর্তমান ঝাড়গ্রাম শহরের রূপকার জঙ্গলমহলের প্রাচীন রাজার আধুনিক প্রাসাদ পর্যটকদের কাছে শহরের সবথেকে জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। মল্লদেব রাজপরিবারের প্রায় চারশো বছরের প্রাচীনতার স্মৃতি বহন করে চলেছে। ১৯৩১ সালে ঝাড়গ্রামের তৎকালীন রাজা নরসিংহ মল্লদেব গথিক শিল্পরীতিতে বর্তমান প্রাসাদটি নির্মাণ করে ছিলেন। প্রাসাদটি তৈরি হয়েছিল রাজপুত স্থাপত্যশৈলীর সাথে ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রনে। পুরোনো রাজবাড়ী গড়ে উঠেছিল মোটামুটি সেই ৪০০ বছর আগে। এখন সেটি রয়েছে নতুন রাজবাড়ী ও গেষ্ট হাউজের পিছনে। বর্তমান রাজ পরিবারের সদস্যরা এই নতুন প্রসাদের দোতলায় বসবাস করেন। একসময়ে এই রাজপরিবারের আতিথ্য গ্রহন করেন ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল উইলিঙডন, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী , প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, পশ্চিবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়, কিংবদন্তি অভিনেতা উত্তমকুমার এবং পশ্চিম বঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্টরা।



ঝাড়গ্রামে এই মল্লদেব রাজপরিবারের রাজ্য স্থাপনের ঘটনা সম্পর্কে বেশ কয়েকটি কাহিনী প্রচলিত আছে। যদি মুঘল যুগের ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করা যায় তবে দেখতে পায় ১৫৭০ সাল নাগাদ দিল্লির সম্রাট আকবরের নির্দেশে বাংলায় আসেন রাজপুতনার বীর যোদ্ধা সর্বেশ্বর সিং চৌহান। ঝাড়গ্রাম অঞ্চলে তখন শাসন করতেন মাল রাজারা। তাঁদের রাজ্য ছিল জঙ্গলে ভর্তি। রাজ্যের নাম ছিল ঝাড়িখন্ড। সর্বেশ্বর সিং চৌহান পদাতিক আর অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে মাল রাজাকে উচ্ছেদ করে মল্লদেব উপাধি ধারণ করেন এবং প্রতিষ্ঠা করলেন নতুন রাজবংশের। রাজধানী হল ঝাড়গ্রাম। তারপর চার শতাব্দী ধরে তাঁর বঙশের ১৮ জন রাজা এখানে রাজত্ব করেছেন।


আবার এও শোনা যায় ..... ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমদিকে ফতেপুর সিক্রি‌ অঞ্চলের ছেত্রি পরিবারের এক সন্তান সর্বেশ্বর মল্লদেব গিয়েছিলেন শ্রীখেত্রে জগন্নাথ দর্শন অভিলাষে। এই সময়ে তাঁর পেছনে পেছনে তাঁদের কুলদেবী সাবিত্রী দেবীও খাড়া হাতে আসতে থাকেন। শ্রীখেত্র থেকে ফেরার সময় সর্বেশ্বরের সন্দেহ হয় যে তাঁকে কেউ অনুসরন করছে। পিছনে তাকাতেই অপ্রস্তুত সাবিত্রী দেবী পাতালে ঢুকে যেতে থাকেন। রাজা ছুটে গিয়ে দেবীর চুলের মুঠিটি ধরে ফেলেন। তাই দেবীর শরীর পাতালে আর মাথার চুল এবং হাতের খাড়াটি উপরে থেকে যায়। ‌অবসন্ন রাজা গাছের নিচে বিশ্রাম নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুমের মধ্যে তিনি এখানে রাজত্ব স্থাপনের জন্য সাবিত্রী দেবীর আদেশ পান। দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে সর্বেশ্বর সিং এই জঙ্গলভূমির মাল বা মল্ল রাজাকে পরাজিত করে রাজত্ব স্থাপন করেন এবং সাবিত্রী দেবীর মন্দির নির্মাণ করেন। রাজার নিযুক্ত ব্রাহ্মন পুরোহিতরা যজমানের কুলকাহিনি এভাবেই রচনা করে প্রচার করেছেন


ঝাড়গ্রাম রাজবংশে জ্যেষ্ঠত্বের অধিকার প্রথা অনুসৃত হয়। সবচেয়ে বড় রাজপুত্রকে যুবরাজ, দ্বিতীয় পুত্রকে হিকিম , তৃতীয় পুত্রকে বড়ঠাকুর, চতুর্থ পুত্রকে কুমার, পঞ্চম পুত্রকে মুসারেন এবং অবশিষ্টদের বাবু বলা হতো। ১৮৫৭ সালে রঘুনাথ মল্লদেব অপ্রাপ্তবয়ষ্ক থাকাকালীন রাজা হয়েছিলেন।   ১৮৮৬ সালে রঘুনাথ প্রাপ্তবয়ষ্ক হয়ে রাজ্য শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং কয়েক বৎসরের মধ্যে প্রায় ৬ লখ্খ টাকা রিনগ্রস্ত হয়ে পরেন। ১৯১২ সালে রঘুনাথের এবং ১৯১৬ সালে তাঁর পুত্র চন্ডীচরনের মৃত্যু হয়। চন্ডীচরনের সাত বছরের শিশু নরসিংহ ইংরেজ সরকারের তত্ত্বাবধানে মেদিনীপুরে পড়াশুনা করেন এবং মেদিনীপুর কলেজের শিক্ষক দেবেন্দ্র মোহন ভট্টাচার্যকে নরসিংহর অভিভাবক হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। ১৯২৯ সালে নরসিংহ সাবালক হয়ে এস্টেটের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন এবং দেবেন্দ্র মোহন কে ম্যানেজার নিযুক্ত করেন।



ঝাড়গ্রাম রাজাদের আরধ্য দেবী হলেন সাবিত্রী দেবী। সাবিত্রী দেবী প্রাচীন শাক্ত দেবী। তাঁদের প্রাচীন মন্দিরটি নিশ্চিহ্ন হওয়ার পর রাজবাড়ীর কাছে বর্তমান মন্দিরটি করা হয়েছে।

এই বঙশের রাজারা দানশীলতা, প্রজাবাৎসল্য এবং সমাজসেবা মূলক কাজের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। রঘুনাথ নিজে ছিলেন যথেষ্ট বিদ্যোৎসাহী গুনী রাজা। তিনিই ছিলেন ঝাড়গ্রামের প্রথম এফ এ পাশ। নরসিংহ মল্লদেব ঝাড়গ্রাম শহরের জলকষ্ট দূর করার জন্য কল বসিয়ে ছিলেন, শিক্ষা বিস্তারের জন্য স্কুল কলেজ স্থাপনের জন্য ভূ-সম্পত্তি দান করেছিলেন। 


জঙ্গলমহলের প্রানকেন্দ্র ঝাড়গ্রামে সুপ্রাচীন অতীতে যেভাবেই মল্লদেব বঙশ রাজত্ব কায়েম করুক না কেন পরবর্তীকালে এই বঙশের রাজারা তাঁদের প্রজাদের কল্যানে প্রশঙনীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। ঝাড়গ্রাম রাজপরিবারই প্রকৃত অর্থে বর্তমান ঝাড়গ্রামের রূপকার।