Sunday, 1 August 2021

ঝাড়গ্রাম রাজার বাড়ি

 


ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ী সম্বন্ধে দু চার কথা ::

বর্তমান ঝাড়গ্রাম শহরের রূপকার জঙ্গলমহলের প্রাচীন রাজার আধুনিক প্রাসাদ পর্যটকদের কাছে শহরের সবথেকে জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। মল্লদেব রাজপরিবারের প্রায় চারশো বছরের প্রাচীনতার স্মৃতি বহন করে চলেছে। ১৯৩১ সালে ঝাড়গ্রামের তৎকালীন রাজা নরসিংহ মল্লদেব গথিক শিল্পরীতিতে বর্তমান প্রাসাদটি নির্মাণ করে ছিলেন। প্রাসাদটি তৈরি হয়েছিল রাজপুত স্থাপত্যশৈলীর সাথে ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রনে। পুরোনো রাজবাড়ী গড়ে উঠেছিল মোটামুটি সেই ৪০০ বছর আগে। এখন সেটি রয়েছে নতুন রাজবাড়ী ও গেষ্ট হাউজের পিছনে। বর্তমান রাজ পরিবারের সদস্যরা এই নতুন প্রসাদের দোতলায় বসবাস করেন। একসময়ে এই রাজপরিবারের আতিথ্য গ্রহন করেন ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল উইলিঙডন, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী , প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, পশ্চিবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়, কিংবদন্তি অভিনেতা উত্তমকুমার এবং পশ্চিম বঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্টরা।



ঝাড়গ্রামে এই মল্লদেব রাজপরিবারের রাজ্য স্থাপনের ঘটনা সম্পর্কে বেশ কয়েকটি কাহিনী প্রচলিত আছে। যদি মুঘল যুগের ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করা যায় তবে দেখতে পায় ১৫৭০ সাল নাগাদ দিল্লির সম্রাট আকবরের নির্দেশে বাংলায় আসেন রাজপুতনার বীর যোদ্ধা সর্বেশ্বর সিং চৌহান। ঝাড়গ্রাম অঞ্চলে তখন শাসন করতেন মাল রাজারা। তাঁদের রাজ্য ছিল জঙ্গলে ভর্তি। রাজ্যের নাম ছিল ঝাড়িখন্ড। সর্বেশ্বর সিং চৌহান পদাতিক আর অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে মাল রাজাকে উচ্ছেদ করে মল্লদেব উপাধি ধারণ করেন এবং প্রতিষ্ঠা করলেন নতুন রাজবংশের। রাজধানী হল ঝাড়গ্রাম। তারপর চার শতাব্দী ধরে তাঁর বঙশের ১৮ জন রাজা এখানে রাজত্ব করেছেন।


আবার এও শোনা যায় ..... ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমদিকে ফতেপুর সিক্রি‌ অঞ্চলের ছেত্রি পরিবারের এক সন্তান সর্বেশ্বর মল্লদেব গিয়েছিলেন শ্রীখেত্রে জগন্নাথ দর্শন অভিলাষে। এই সময়ে তাঁর পেছনে পেছনে তাঁদের কুলদেবী সাবিত্রী দেবীও খাড়া হাতে আসতে থাকেন। শ্রীখেত্র থেকে ফেরার সময় সর্বেশ্বরের সন্দেহ হয় যে তাঁকে কেউ অনুসরন করছে। পিছনে তাকাতেই অপ্রস্তুত সাবিত্রী দেবী পাতালে ঢুকে যেতে থাকেন। রাজা ছুটে গিয়ে দেবীর চুলের মুঠিটি ধরে ফেলেন। তাই দেবীর শরীর পাতালে আর মাথার চুল এবং হাতের খাড়াটি উপরে থেকে যায়। ‌অবসন্ন রাজা গাছের নিচে বিশ্রাম নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুমের মধ্যে তিনি এখানে রাজত্ব স্থাপনের জন্য সাবিত্রী দেবীর আদেশ পান। দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে সর্বেশ্বর সিং এই জঙ্গলভূমির মাল বা মল্ল রাজাকে পরাজিত করে রাজত্ব স্থাপন করেন এবং সাবিত্রী দেবীর মন্দির নির্মাণ করেন। রাজার নিযুক্ত ব্রাহ্মন পুরোহিতরা যজমানের কুলকাহিনি এভাবেই রচনা করে প্রচার করেছেন


ঝাড়গ্রাম রাজবংশে জ্যেষ্ঠত্বের অধিকার প্রথা অনুসৃত হয়। সবচেয়ে বড় রাজপুত্রকে যুবরাজ, দ্বিতীয় পুত্রকে হিকিম , তৃতীয় পুত্রকে বড়ঠাকুর, চতুর্থ পুত্রকে কুমার, পঞ্চম পুত্রকে মুসারেন এবং অবশিষ্টদের বাবু বলা হতো। ১৮৫৭ সালে রঘুনাথ মল্লদেব অপ্রাপ্তবয়ষ্ক থাকাকালীন রাজা হয়েছিলেন।   ১৮৮৬ সালে রঘুনাথ প্রাপ্তবয়ষ্ক হয়ে রাজ্য শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং কয়েক বৎসরের মধ্যে প্রায় ৬ লখ্খ টাকা রিনগ্রস্ত হয়ে পরেন। ১৯১২ সালে রঘুনাথের এবং ১৯১৬ সালে তাঁর পুত্র চন্ডীচরনের মৃত্যু হয়। চন্ডীচরনের সাত বছরের শিশু নরসিংহ ইংরেজ সরকারের তত্ত্বাবধানে মেদিনীপুরে পড়াশুনা করেন এবং মেদিনীপুর কলেজের শিক্ষক দেবেন্দ্র মোহন ভট্টাচার্যকে নরসিংহর অভিভাবক হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। ১৯২৯ সালে নরসিংহ সাবালক হয়ে এস্টেটের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন এবং দেবেন্দ্র মোহন কে ম্যানেজার নিযুক্ত করেন।



ঝাড়গ্রাম রাজাদের আরধ্য দেবী হলেন সাবিত্রী দেবী। সাবিত্রী দেবী প্রাচীন শাক্ত দেবী। তাঁদের প্রাচীন মন্দিরটি নিশ্চিহ্ন হওয়ার পর রাজবাড়ীর কাছে বর্তমান মন্দিরটি করা হয়েছে।

এই বঙশের রাজারা দানশীলতা, প্রজাবাৎসল্য এবং সমাজসেবা মূলক কাজের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। রঘুনাথ নিজে ছিলেন যথেষ্ট বিদ্যোৎসাহী গুনী রাজা। তিনিই ছিলেন ঝাড়গ্রামের প্রথম এফ এ পাশ। নরসিংহ মল্লদেব ঝাড়গ্রাম শহরের জলকষ্ট দূর করার জন্য কল বসিয়ে ছিলেন, শিক্ষা বিস্তারের জন্য স্কুল কলেজ স্থাপনের জন্য ভূ-সম্পত্তি দান করেছিলেন। 


জঙ্গলমহলের প্রানকেন্দ্র ঝাড়গ্রামে সুপ্রাচীন অতীতে যেভাবেই মল্লদেব বঙশ রাজত্ব কায়েম করুক না কেন পরবর্তীকালে এই বঙশের রাজারা তাঁদের প্রজাদের কল্যানে প্রশঙনীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। ঝাড়গ্রাম রাজপরিবারই প্রকৃত অর্থে বর্তমান ঝাড়গ্রামের রূপকার।