Wednesday, 29 June 2022

চাঁদ সওদাগরের শিবমন্দির

 

চম্পকনগরে চাঁদ সওদাগরের শিবমন্দির 


মনসামঙ্গল কাব্যের একটি কিংবদন্তী চরিত্র চাঁদ সওদাগর। চম্পকনগরের কথা মনে আছে তো ? হ্যা, মনসামঙ্গল কাব্যের চম্পকনগর। যেখানে রাজত্ব ছিল চাঁদ সওদাগরের। তিনি ছিলেন একজন ধনী ও ক্ষমতাশালী বণিক। অধুনা পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলাতে অবস্থিত চম্পাইনগরী বা কসবা-চম্পকনগরীই হল চাঁদ সওদাগরের  চম্পকনগরী। চাঁদ সওদাগর ও মনসা দেবীর দ্বন্ধের কাহিনী গড়ে উঠেছিল একালের কসবা-চম্পকনগরী ঘিরেই। মনসামঙ্গলে আছে .......... চম্পকনগরে বৈসে চাঁদ সওদাগর,‌‌             মনসা সহিত বাদ করে নিরন্তর।                           একনিষ্ঠ শিব ভক্ত চাঁদ সওদাগরের সঙ্গে দেবী মনসার মন কষাকষির লড়াই হয়েছিল এইখানেই। চাঁদ সওদাগরের উপাখ্যানের সঙ্গেই সর্পদেবী মনসার পূজা প্রচারের কাহিনীটি জড়িত। আর আজও এখানে পূজো পাচ্ছেন চাঁদ সওদাগরের প্রতিষ্ঠিত শিব লিঙ্গ।

পাথরে খোদাই করা চাঁদ সওদাগরের মূর্তি


এই অঞ্চলের শিরায় শিরায় জড়িয়ে রয়েছে চাঁদ সাওদাগর, বেহুলা-লক্ষিন্দর এবং মা মনসার কাহিনী। এই  চম্পকনগরেই অবস্থিত মনসামঙ্গল খ্যাত এবং চাঁদ সওদাগর প্রতিষ্ঠিত বাবা রামেশ্বর শিব মন্দির এবং মা মনসার মন্দির।  চাঁদ সওদাগর এই মন্দিরে শিবের নিত্য পূজা করতেন এবং এই মন্দিরেই মিলন হত ভক্ত ও ভগবানের। 


দৃরে দেখা যায় বেহুলা-লক্ষিন্দরের মন্দির 

রামেশ্বর শিব মন্দিরের পিছনের দিক

 এই মন্দির ছাড়াও দেখতে পাবেন সান্তালি  পর্বত ,যেখানে বেহালা লক্ষিন্দরের লোহার     বাসর ঘর তৈরী হয়েছিল, যা এখন সতীতীর্থ নামে পরিচিত।  এখানে অনেকগুলি মন্দিরের ভগ্নাবশেষ দেখা যায়। কিছু মন্দির পুন:নির্মান করা হয়েছে যার মধ্যে মনসা মন্দির একটি। প্রাচীন শিবমন্দির এখন আর নেই।  এখন অনেকগুলি সিড়ি পেড়িয়ে উচু ঢাবির উপরে অবস্থিত মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। মন্দিরে রয়েছে ছয় কোনা বিশিষ্ট ছয় ফুট উচ্চতা এক শিবলিঙ্গ।  মানুষ দু হাতে বেড় দিয়ে ধরতে সক্ষম নয়।  পুজো করার জন্য  সিঁড়ি দিয়ে  উঠে বসার ব্যবস্থা আছে।  শিব এখানে গৌরিপট্টহীন। রামেশ্বর শিবের পাশেই পুরোনো বট গাছের নীচেই রয়েছেন বানেশ্বর শিব।  কথিত আছে কালাপাহাড় বানেশ্বরের মাথায় আঘাত করার ফলে ফিনকি দিয়ে রক্ত পরতে শুরু করে, সেই রক্ত জমে সৃষ্টি হয় রক্তপুকুর। এখন অবশ্য পুকুরে  কাদা ছাড়া কিছু নেই। 

বানেশ্বর শিব 



এই সেই রক্তপুকুর ও দূরে রামেশ্বর শিব মন্দির 


দেবী মনসা তখনও মর্তলোকে পূজিত হন না এবং তাঁর পূজো প্রচলনের জন্য তিনি প্রথম তেজস্বী পুরুষ চাঁদ সওদাগরের কাছে যান। চাঁদ সওদাগর দেবী মনসাকে পূজো করতে অস্বীকার করেন।  দেবী মনসার রোষানলে পরেন চাঁদ সওদাগর।  একে একে তার সমস্ত পুত্ররা মারা যান। তার সপ্তডিঙ্গা ডুবে যায়। তবুও চাঁদ সওদাগর নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।  শেষমেশ সতী বেহুলার অনুরোধে দেবী মনসাকে তিনি বাম হস্তে পুষ্প প্রদান করেন এবং  সেইথেকে মর্তলোকে দেবী মনসার পূজার প্রচলন হয়।

মা মনসা দেবী


বিষদভাবে এই  ঘটনাই হিন্দু লোককথায় বর্ননা এইরকম:: 

হিন্দু লোককথা অনুযায়ী, চাঁদ সদাগর ছিলেন শিবের ভক্ত। মনসা চাঁদের পূজা কামনা করলে শিবভক্ত চাঁদ তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। মনসা ছলনার আশ্রয় নিয়ে চাঁদের পূজা আদায় করার চেষ্টা করলে, চাঁদ শিবপ্রদত্ত ‘মহাজ্ঞান’ মন্ত্রবলে মনসার সব ছলনা ব্যর্থ করে দেন। তখন মনসা সুন্দরী নারীর ছদ্মবেশে চাঁদের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে তার গুপ্তরহস্য জেনে নেন। এর ফলে চাঁদ মহাজ্ঞানের অলৌকিক রক্ষাকবচটি হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু এরপরেও চাঁদ সদাগর তার বন্ধু ধন্বন্তরীর অলৌকিক ক্ষমতাবলে নিজেকে রক্ষা করতে থাকেন। ধন্বন্তরী চাঁদের থেকেও অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন। তাই ছলনা করে মনসা তাকে হত্যা করেন। এরপর চাঁদ যথার্থই অসহায় হয়ে পড়েন।

এরপরেও চাঁদ মনসার পূজা করতে অস্বীকার করলে, মনসা সর্পাঘাতে চাঁদের ছয় পুত্রের প্রাণনাশ করেন। ভগ্নহৃদয় চাঁদ এতে বাণিজ্যে যাওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু শত দুঃখকষ্টের মধ্যেও তিনি আবার বাণিজ্যে বের হন। সফল বাণিজ্যের পর তিনি যখন ধনসম্পদে জাহাজ পূর্ণ করে গৃহে প্রত্যাবর্তন করছেন, তখনই মনসা প্রচণ্ড ঝড় তুলে তার বাণিজ্যতরী শেরপুর শহরের অদূরে গরজরিপার অন্তর্গত কালিদাস সাগর ডুবিয়ে দেন। চাঁদের সঙ্গীরা মারা গেলেও চাঁদ প্রাণে বেঁচে যান। দুর্গা চাঁদকে রক্ষা করতে যান কালিদাস সাগরে। কিন্তু মনসার অনুরোধক্রমে শিব তাকে বারণ করেন। এরপর মনসা চাঁদকে ভাসিয়ে সমুদ্রের তীরে চন্দ্রকেতুর কাছে পৌঁছে দেন।


চন্দ্রকেতু চাঁদকে দিয়ে মনসার পূজা করানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু চাঁদ তাতে সম্মত হন না। তাকে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করতে হয়। তা সত্ত্বেও তিনি শিবদুর্গার পূজা করে চলেন। মনসা তখন স্বর্গের দুই নর্তক-নর্তকীর সহায়তা নেন। তাদের একজন চাঁদ সদাগরের পুত্র রূপে এবং অপর জন চাঁদের বন্ধু সয়া বেনের কন্যা রূপে জন্মগ্রহণ করেন।

চম্পক নগরে ফিরে এসে চাঁদ কোনোক্রমে নিজের জীবন পুনরায় সাজিয়ে তুলতে সক্ষম হন। তার লখিন্দর নামে একটি পুত্র জন্মে। এদিকে সয়াবেনের স্ত্রী একটি কন্যার জন্ম দেয়, তার নাম রাখা হয় বেহুলা। দুজনে একসঙ্গে বেড়ে ওঠেন। তাদের অভিভাবকেরা দুজনের বিবাহের কথা চিন্তা করেন। কিন্তু কোষ্ঠী মিলিয়ে দেখা যায়, বিবাহরাত্রেই বাসরঘরে সর্পাঘাতে লখিন্দরের মৃত্যুর কথা লেখা আছে। কিন্তু মনসার ভক্ত বেহুলা ও লখিন্দর ছিলেন রাজযোটক। তাই শেষ পর্যন্ত উভয়ের বিবাহ স্থির হয়। লখিন্দরের প্রাণরক্ষা করতে চাঁদ একটি লৌহবাসর নির্মাণ করে দেন।

বেহুলার ভেলাযাত্রা, মনসামঙ্গল কাব্যের একটি পটচিত্র

এত সুরক্ষা সত্ত্বেও মনসা ঠিক পথ বের করে একটি সাপ পাঠিয়ে লখিন্দরের প্রাণনাশ করেন। সেযুগে প্রথা ছিল, সর্পদংশনে মৃত্যু হলে মৃত ব্যক্তিকে দাহ না করে কলার ভেলায় করে ভাসিয়ে দেওয়া হত। বেহুলা তার মৃত স্বামীর সঙ্গ নেন। সকলেই তাকে বারণ করেন। কিন্তু বেহুলা কারোর নিষেধ শোনেন না। ছয় মাস ধরে বেহুলা ভেলায় ভাসতে থাকেন। তিনি গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে চলেন। লখিন্দরের মৃতদেহে পচন ধরে। গ্রামবাসীরা তাকে উন্মাদ মনে করেন। বেহুলা মনসার কাছে প্রার্থনা করতে থাকেন। কিন্তু মনসা শুধু ভেলাটিকে ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা ছাড়া কিছুই করেন না।

প্রাচীন বটগাছে ঘেরা শিব মন্দির 


কলার ভেলা ভাসতে ভাসতে মনসার সহচরী নেতার ঘাটে এসে ভিড়ল। সেই ঘাটে কাপড় কাচত নেতা। বেহুলার প্রার্থনা শুনে নেতা ঠিক করেন যে তাকে নিয়ে যাবেন মনসার কাছে। নিজের অলৌকিক ক্ষমতাবলে তিনি বেহুলা ও মৃত লখিন্দরকে স্বর্গে উপস্থিত করেন। মনসা বেহুলাকে বলেন, “যদি তোমার শ্বশুরকে দিয়ে আমার পূজা করাতে পারো, তবে তুমি তোমার স্বামীর প্রাণ ফিরে পাবে।” 



বেহুলা শুধু বলেন, “আমি করবই।” আর তাতেই তার মৃত স্বামীর দেহে প্রাণ সঞ্চারিত হয়। তার পচাগলা দেহের অস্থিমাংস পূর্বাবস্থায় ফিরে আসেন। তিনি চোখ মেলে তাকান এবং বেহুলার দিকে তাকিয়ে হাসেন।

নেতা তাদের মর্ত্যে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। বেহুলা তার শাশুড়িকে সব ঘটনা বিবৃত করেন। তিনি চাঁদ সদাগরকে গিয়ে সব কথা জানান। চাঁদের পক্ষে আর না বলা সম্ভব হয় না।

প্রতিমাসের কৃষ্ণা একাদশী তিথিতে চাঁদ সদাগর মনসার পূজা করতে সম্মত হন। কিন্তু মনসা তাকে যে কষ্ট দিয়েছিলেন, তা তিনি সম্পূর্ণ ক্ষমা করতে পারেন না। তিনি বাম হাতে প্রতিমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মনসাকে পূজা করতে থাকেন। মনসা অবশ্য তাতেই সন্তুষ্ট হন। এর পর চাঁদ সদাগর ও তার পরিবার সুখে শান্তিতে বাস করতে থাকে। চাঁদ-এর ছয় পুত্রকেও মনসা জীবন দান করেন। চাঁদ সদাগরের মতো ধনী ও প্রভাবশালী বণিক মনসার পূজা করায় মনসার পূজা বৃহত্তর জনসমাজে প্রচার লাভ করে।

বর্তমান মনসা মন্দির 

মন্দিরে মনসা দেবী


চম্পাইনগর যেহেতু মনসামঙ্গলের সাথে জড়িত, তাই এখানকার অধিষ্ঠিত দেবী মা মনসা। গ্রামের প্রখ্যাত জমিদার ছিলেন নায়েক বংশধারী। জমিদার বাড়ী সংলগ্ন এক মন্দিরে নায়কদের দ্বারা মনসাদেবী নিত্য পূজিত হন। শ্রাবণ সংক্রান্তিতে পালিত হয় বিশেষ উৎসব ও মেলা বসে। সেখানে এই গ্রামের কামার, কুমার ও বেনে সম্প্রদায়ের লোকেরা এখনও মাটি খুঁড়ে উনুন তৈরি করতে পারেন না, এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে। এই কাজ তাদের অন্য সম্প্রদায়কে দিয়ে করাতে হয়।

মন্দিরের প্রবেশমুখের সিড়ি






মন্দিরের সন্মুখভাগ



গৌরিপট্টহীন রামেশ্বর শিব লিঙ্গ 


প্রত্যহ এই মন্দিরে পূজো হয় এবং পূজা করবার জন্য  পূজারিও রয়েছেন।শ্রাবণ মাসে প্রত্যেক সোমবার ভক্তদের ভীর উপচে পরে। এছাড়া চৈত্র মাসের গর্জন ও শিবরাত্রি উপলক্ষে এখানে ১০ দিনের মেলা ও বাৎসরিক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। দূরদূরান্ত থেকে প্রায় কয়েক লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। তখন  শৈব উপাসক ও মনসা উপাসক মানুষের সহাবস্থান দেখা যায় এই অঞ্চলে। স্থানীয়দের দাবী ঠিক না ভুল সে প্রসঙ্গ ভিন্ন, তবে নির্জন শান্ত পরিবেশে আপনি হয়তো অনুভব করতে পারবেন বেহুলার দু:খের কথা অথবা লক্ষিন্দরের প্রতি প্রেমে অবদানের দিনলিপি।

গৌরিপট্টহীন রামেশ্বর শিব 


বেহুলা-লক্ষিন্দরের বাসরঘর পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হয়েও , নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে একবিংশ শতকে।  আজ চাঁদ সওদাগর নেই। নেই তার প্রতাপ।  তবে আজও বর্তমান চম্পকনগর। এই জায়গায় এলেই পৌঁচ্ছে যাবেন কয়েকযুগ আগে। মুখোমুখি দেখা হবে ইতিহাসের সঙ্গে। 

বর্ধমান জেলার পানাঘর থেকে প্রায় ২০ কিমি দক্ষিণে দামোদর  নদীর উত্তর তীরে রয়েছে এই স্থান। এছাড়া বুদবুদ থেকে কসবা হয়েও পৌচ্ছানো যায় চম্পকনগরে। বুদবুদ হয়ে দূরত্ব একটু বেশী হলেও এই রাস্তাটি অপেক্ষাকৃত ভালো।