Tuesday, 3 October 2023

স্থাপত্যের উজ্জ্বলতা---- জটিলেশ্বর শিবমন্দির

 


অনাবিষ্কৃতপ্রায় , ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতির বাহক ময়নাগুড়ির জটিলেশ্বর শিব মন্দির। 

মন্দিরের প্রধান গেট


মন্দিরের সন্মুখভাগ 


উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি ব্লকে সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী অনেকগুলি মন্দির রয়েছে। এই তীর্থ ক্ষেত্রগুলির "জল্পেশ মন্দির " এবং " জটিলেশ্বর মন্দির " ভারত বিখ্যাত।  ময়নাগুড়ি থেকে প্রায় ১১ কিমি দূরে চুরাভান্ডার গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন মল্লিকহাট এলাকায় রয়েছে জটিলেশ্বর মন্দির।  তবে এই মন্দির কে গড়েছিলেন বা কবে তা তৈরি হয়েছিল তা আজও এক রহস্যের অন্ধকারে ঢাকা রয়েছে। 


বাবা জটিলেশ্বর 


ইতিহাস ঘাটলে মন্দির নির্মাণ সম্পর্কে যে সব তথ্য জানা যায় সেগুলি এই রকম। একদল গবেষক তাদের গবেষণার পর সিদ্ধান্তে এসেছেন যে এটি পাল যুগে তৈরি হয়েছিল।  অন্য গবেষক দল জানিয়েছেন মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল পালযুগের অনেক আগে অর্থাৎ  গুপ্তযুগের আমলে। আবার প্রত্নতত্ত্ববিদরা  প্রত্নতত্তিক উপাদান নিয়ে  গবেষণার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে এই মন্দিরের বয়স কমপক্ষে  হাজার বছরেরও বেশি। কিংবদন্তিতে যাদের বিশ্বাস তাঁরা বলে থাকেন যে এই মন্দির ৩২০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তৈরী হয়েছিল।  সময়ের কারনে মন্দিরের দেওয়াল বারবার সংস্কারের ফলে মন্দিরের পুরানো ঐতিহ্য অনেকটাই মুছে গিয়েছে। তবু আজও এই মন্দির সেই পুরোনো দিনের মতই জটাজুটধারী শিবের উপাসনাস্থল হিসেবেই ভক্তদের কাছে বিশেষ ভাবে পরিচিত। 




মন্দির এলাকায় বিভিন্ন পাথরের মূর্তি



গুপ্ত রাজবংশের দ্বারা নির্মিত হওয়ায় এই মন্দির বহু পুরানো ও বলা যেতে পারে উত্তরবঙ্গের প্রাচীনতম মন্দিরগুলির মধ্যে একটি। এইজন্য এর ঐতিহাসিক গুরুত্বের আধিক্য রয়েছে। বলা যেতে পারে ভারতের মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের স্বতন্ত্রের প্রতীক।  মন্দিরটি পাথর ও মাটির ইট ব্যবহার করে নির্মিত হয়েছিল।  যদিও এটি ভগবান শিবের মন্দির,  মন্দিরের দেওয়াল গুলিতে অন্যান্য হিন্দু দেবতার মূর্তি দিয়ে ভাস্কর্য করা হয়েছে। পাশেই রয়েছে লক্ষী-নারায়ন মন্দির।  আর রয়েছে মা কালীর মন্দির।  মন্দির এলাকায় প্রবেশের জন্য দর্শক প্রতি ৫ টাকা করে টিকিট কাটতে হয়। তবে একবার ভিতরে ঢুকলে পরে ঐ এলাকা জুড়ে এক শান্তির ছায়া পাবেন এবং ইচ্ছা হবে বট গাছের তলায় বসে কিছুটা সময় কাটাতে পারলে ভালো হতো।




জলঢাকা নদী বয়ে চলেছে এই মন্দিরের খুব কাছ দিয়ে। মন্দির ঠিক কতটা প্রাচীন এই তর্কে অংশ গ্রহণ না করে ভক্তরা আসেন জটিলেশ্বর মন্দিরে তাদের যাবতীয় কষ্ট থেকে মুক্তি পাবার জন্য।  এই মন্দির অত্যন্ত জাগ্রত....... এটাই ভক্তদের গভীর বিশ্বাস।  আর এই মন্দিরের দেবতা  বাবা জটিলেশ্বর তার ভক্তদের খালিহাতে ফেরান না। ভোলানাথের কৃপায় এই মন্দিরে এসে বাবার কাছে চাইলে সে যতই কঠিন ও জটিল সমস্যাই হোক না কেন,  ভক্তরা তা থেকে মুক্তি পান। এই বিশ্বাসের উপর ভর করে দেখা যায় যে বহু ভক্তই এখানে আসছেন বংশ পরম্পরায়। 



বাগডোগরা বিমানবন্দর এখান থেকে ৮৫ কি মি। সেখান থেকে ভাড়ার গাড়িতে এখানে চলে আসতে পারেন।  রেলে আসতে গেলে নিউ ময়নাগুড়ি ষ্টেশন থেকে ১৪ কি মি দূরে এই মন্দির।  সঢ়কপথে ময়নাগুড়িতে এসে সেখান থেকে বাস বা ট্যাক্সি করে হুসলুরডাঙ্গা চলে আসুন।  আর সেখান থেকে আরামে সহজে পৌচ্ছে যান মন্দিরে।

মা কালীর মূর্তি

প্রাচীন বটগাছে মানত করা


মন্দিরের দেওয়ালে পাথরের মূর্তি


জটিলেশ্বর মন্দিরকে ঢেলে সাজাতে উদ্যোগী হয়েছে পর্যটন দফতর।  রাজ্য পর্যটন দফতর চায়, ইতিহাস সমৃদ্ধ এই এলাকাটি সাধারণ পর্যটকের কাছে তুলে ধরতে। সেজন্য " ডুয়ার্স মেগা ট্যুরিস্ট " প্রকল্পের অধীনে এই মন্দির এনে ,পুরোনো কাঠামো অক্ষত রেখেই, পর্যটন মন্ত্রকের আর্থিক সহযোগিতায় মন্দির চত্বর ঢেলে সাজনো হচ্ছে। এমনিতেই ময়নাগুড়ি খুব সুন্দর জায়গা। এক দিকে তিস্তা আর এক দিকে জলঢাকা। পাশেই গরুমারা। ভ্রমনার্থীদের সুবিধার জন্য নিউ জলপাইগুড়ি ষ্টেশন থেকেই বাস পরিষেবা চালুর পরিকল্পনা নিয়েছে পর্যটন দফতর। এসব পরিকল্পনা সফল হলে তখন বলা যাবে ডুয়ার্স বলতে শুধুই  জঙ্গল বা চা বাগান  বা নির্সগতা  বোঝায় না, ডুয়ার্স বলতে সুপ্রাচীন এক সভ্যতার নিদর্শন। 





Sunday, 17 September 2023

জলমগ্ন মঙ্গলের প্রতিক--- জল্পেশ্বর শিব

 


ময়নাগুড়ির জল্পেশ মন্দিরে জল্পেশ্বর শিব 

উত্তরবঙ্গের নামী শিবমন্দিরগুলির অন্যতম জল্পেশ।  ভগবান শিবের প্রাচীন মন্দির।  এই মন্দিরের প্রধান দেবতা  "জল্পেশ্বর" অর্থাৎ ভগবান শিবের একটি রুপ। এই ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যমন্ভিত মন্দিরটি জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি থেকে আট কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।  পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে জরদা নদী। এখানে শিবলিঙ্গ হল জল লিঙ্গ।  অর্থাৎ শিবলিঙ্গ এখানে গর্তের মধ্যে জলের ভিতর থাকেন যাকে বলা হয় জল লিঙ্গ  বা অনাদি। গর্তে জল ঢেলে পূন্য অর্জন করতে হয়। কথিত আছে এই মন্দির ভ্রামরী শক্তিপীঠের সঙ্গে জড়িত। জলেশ্বর হলেন দেবী ভ্রামরীর ভৈরব। মন্দিরটি মনোরম স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত। পুরাণ অনুযায়ী , এই মন্দির হাজার বছরেরও বেশী পূরানো। অনেকেই বলেন , দিল্লির মুসলমান স্থপতিরা এই মন্দির তৈরি করেন বলে মন্দিরের চূড়া গম্বুজাকৃতি। মন্দিরটি ১২৪ ফুট দীর্ঘ,  ১২০ ফুট চওড়া আর উচ্চতা ১২৭ ফুট। মন্দিরে নারায়ণ,  কালী, কুবেশ্বর এবং ভ্রামরী দেবীর মূর্তিও  আছে। মন্দির কমিটি ভক্তদের কাছ থেকে কুড়ি টাকা ( সাধারণ) থেকে একশো টাকা ( স্পেশাল ) টিকিট বাবদ নিয়ে থাকেন।  তা দিয়ে মন্দিরের বিভিন্ন সময়ে নানা সংস্কার হয়ে থাকে। এই মন্দিরে ৭ জন পুরোহিত  ও ৩০ জন কর্মচারী আছেন। প্রতি মাসে কয়েক লক্ষ টাকা খরচ হয় তাদের বেতন বাবদ। ট্রাষ্টি বোর্ডের কর্মকর্তা জানালেন মন্দিরের এসব খরচের টাকা বেশিরভাগ মেলার সময় রোজগার হয়। এছাড়া  বহু লোক প্রচুর দান করেন। আর টিকিট বিক্রির  টাকা দিয়ে মন্দির রক্ষণাবেক্ষণ চলে।  মহাশিবরাত্রিতে ও শ্রাবন মাসে লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থীর ভিড় হয়।  অনেকেই মানত করে তিস্তা থেকে হেঁটে হেঁটে কাধে বাক নিয়ে মন্দিরে পৌচ্ছায়। শিবলিঙ্গে জল নিবেদনের ঐতিহ্য একটি প্রাচীন রীতি যা আজও অগাধ ভক্তি ও বিশ্বাসের সাথে অনুসরণ করা হয়।



জল্পেশ মন্দির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বৃহত্তম শৈব তীর্থ। এই শৈবক্ষেত্রে জনপ্লাবন দেখতে হলে আপনাকে আসতে হবে শিবরাত্রির সময় বা শ্রাবন মাসে। লোকপুরান বা লোকবিশ্বাসকে যদি আপনি আলোচনা করেন তবে দেখা যায় যে প্রাচীন সিল্ক রুট বা রেশম পথের উপর গড়ে উঠেছিল এই জল্পেশ মন্দির।  আদি নাম গড়তলি। জল্পেশের উল্লেখ আছে কালিকাপুরান বা স্কন্দপুরানে। প্রচলিত বিশ্বাস , প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা জল্প অথবা জল্পেশ এখানে মন্দির তৈরি করেন। তার নামেই নামকরন হয় এই মন্দিরের।  তবে এই বিশ্বাসের কোনো প্রমাণ নেই। আবার পুরোনো গল্প কাহিনী থেকে জানা যায়, স্বামীর মৃত্যুর পর অসমের রানী ময়নামতি  জল্পেশের কর্পূর জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলেন।  সেখানে সাধু ছদ্মবেশে সেনাপতি হানা দিলে যুদ্ধ হয়। সেনাপতি মারা যান।  পরবর্তীতে তিনি ধোওলা ঠাকুর নামে দেবায়িত হন। মন্দিরের পাশে সেই থান  রয়েছে। তবে এই বিশ্বাসেরও ঐতিহাসিক তথ্য তেমন মেলে না। 


ইতিহাস ঘাটাঘাটি করলে দেখা যায় যে  শ্রী বিশ্ব সিংহ ১৫২৪ সালে জল্পেশ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ইনি ছিলেন কোচবিহার মহারাজা নরনারায়নের পিতা। পরবর্তীকালে ১৫৬৩ সালে মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেন।  আবার ১০০ বছর পরে রাজা প্রান নারায়ণ ১৬৬৩ সালে মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেন। এরপর কোচবিহারের রাজা লক্ষী নারায়ণের রাজত্ব কালে কোচ রাজবংশের বশ্যতা অস্বীকার করার পর, মহাদেব রায়কত তার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং কোচ রাজাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে অস্বীকার করেন।  এরপর থেকে মন্দিরটি বৈকুন্ঠপুরের রায়কতদের তত্ত্বাবধানে ছিল।  ১৮৯৯ সালের ৩০ শে জানুয়ারি রাজা গজেন্দ্র দেব রায়কতের স্ত্রী রানী জগদেশ্বরী দেবী এর  পুনপ্রতিষ্ঠা করেন। "মহাশিবরাত্রী" এই মন্দিরটির উদযাপনের প্রধান উৎশব। এছাড়া শিবের কাছে বিশেষ পূজা করার জন্য আগষ্ট মাসে শ্রাবনী মেলায় প্রচুর তীর্থযাত্রীর সমাগম হয়ে থাকে। 





সপ্তদশ শতকে মন্দির তৈরির পর থেকেই এখানে শিবরাত্রিতে বিখ্যাত মেলার সূচনা। সেই দিক থেকে মেলাটি গোটা রাজ্যেরই প্রাচীন মেলাগুলির অন্যতম। ডুয়ার্স যখন ভুটানের অংশ ছিল, তখন ময়নাগুরিকে কেন্দ্র করেই পাহাড় ও সমতলের ব্যবসা হত। ফলে এই মেলার বানিজ্যিক গুরুত্ব ছিল  অসীম। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা হওয়ার আগে এখানে হাতি বিক্রি হত।  নেপাল, ভূটান, বাংলাদেশ ও অন্যান্য নিকটবর্তী রাজ্যের লোকেরা এখানে মেলায় আসে। 



শিব উপাসকদের কাছে এই মহাশিবরাত্রি এক বিশেষ দিন। শিব ও শক্তির মহামিলনকে কেন্দ্র করেই উদযাপনের হয় শিবরাত্রি। মন্দিরের ভিতরে " ওঁম শিবায় নম: " ধ্বনিতে মেতে থাকে চার প্রহর। স্থানীয় লোকজন এই উদযাপনকে শুভ ও সমৃদ্ধির বাহক বলে বিশ্বাস করে। এক মাস ব্যাপী এই মেলায় যে রেকর্ড ভীর হয়, তা চরম জনপ্রিয়তাকেই প্রমান করে। শুধু স্থানীয় লোকজনই নয়, ভারতের দূরদূরান্তের মানুষও এই মেলায় অংশ নিতে আসে। এই মেলার উপর প্রচুর মানুষের রুটি রোজগার নির্ভর করে। দেখাযায় বছরের প্রায় ছয় মাসের রোজগার এই মেলা থেকে হয়ে থাকে। তবে শিবরাত্রির পাশাপাশি শ্রাবন মাসেও এখানে ভিড় করেন ভক্তের দল। স্থানীয় লোকেরা এই মেলাকে শ্রাবনী মেলা হিসেবেই চেনে। সেই সময় " হর হর মহাদেব " ধ্বনিতে মুখরিত হয় মন্দির ও মেলা চত্বর।  দুটি মেলাই বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষকে তাদের জাতি, ধর্ম এবং সংস্কৃতি নির্বিশেষে একত্রিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়।




Tuesday, 7 March 2023

আলপনাময় লবন্ধা


" সুন্দরী লবন্ধা " ....... আউশগ্রামের জঙ্গলমহলের পর্যটনের এক নয়া ঠিকানা ~~~~~

গ্রামের নাম লবন্ধা।  উচ্চারণ করতে সত্যিই একটু কষ্ট হয়। তাই গ্রামবাসীরা চলতি কথায় লবনধার বলে।কিন্ত কেন এমন নাম হ'ল ?? কেউ তার সদুত্তর দিতে পারে না। তবে বইতে পড়া যে কোনো গ্রাম্য পরিবেশের সাথে মিলিয়ে নিতে পারেন এই গ্রামকে। অথবা গ্রাম্যকবির লেখা যে কোনো কবিতার সাথে হুবোহুব মিল খুজে পাবেন এই গ্রাম্যের। সেখানে গ্রামের মেঠো রাস্তায় এখনও চলে গরুর গাড়ী। মরশুমে দেখতে পাবেন ধান বোঝায় গরুর গাড়ি চলছে  মাঠ থেকে ধান নিয়ে চাষির বাড়ীতে। ছোট চাষিরা তাদের ধান মাঠ থেকে বাঁকে নিয়ে চলেছে নিজের বাড়ির গোলায়। নিত্যদিন সন্ধায় রাস্তার ধুলো উড়িয়ে সারি বেধে ফেরে গবাদি পশুর দল। গ্রামের পুকুরের পাশ দিয়ে যদি আপনি যান, তবে অবশ্যই দেখতে পাবেন দল বেধে হাঁসেদের জলকেলি আর গুগলি, ছোটমাছ খাবার দৃশ্য।  দূশনহীন বাতাসে আপনি উপভোগ করতে পারবেন সুসজ্জিত এক গ্রাম্য পরিবেশ।  চতুর্দিকের গ্রাম্যছবি, আপনার চোখ জুড়িয়ে দেবে। 









বাংলার এই গ্রামের আদিবাসী রমনীরা শুধু নিজেরাই সাজেন না। নিজেদের ঘর, গৃহস্থলীও সাজাতে ভালোবাসেন।  সেজন্যই পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রাম দু নম্বর ব্লকের জঙ্গলমহলের লবনধার গ্রাম কারুর কাছে " ছবির গ্রাম " আবার কারুর কাছে " আলপনার গ্রাম  " হিসাবে পরিচিত হয়েছে। এই গ্রামের প্রতিটি দেওয়াল,  মন্দিরের দেওয়াল বা লোকের বাড়ির প্রাচীরে শোভা পায় আদিবাসী রমণী বা স্থানীয় যুবক যুবতীদের আঁকা ছবিতে। দূর দুরন্ত থেকে মানুষ ভীর জমান আলপনা বা ছবি দেখার জন্য।  ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের প্রশংসা করতে একটুও সংকোচ বোধ করেন না।









মানকর ষ্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে কিছুটা  যাবার  পর প্রধান রাস্তা ছেড়ে  দিয়ে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে শাল, সেগুন, মহুয়ার ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বেশ খানিকটা পথ যেতে যেতে আপনি পেয়ে যাবেন গ্রামটি। মনেহবে জঙ্গল পরিষ্কার করেই গ্রামটি তৈরি করা হয়েছে। গ্রামে রয়েছে প্রায় ১০০টি বাড়ি। বর্ধমানের বুদবুদের দেবশালা পঞ্চায়েতের অধীন এই গ্রাম। বিশেষ করে গাছ, জঙ্গল বাঁচাতে দেওয়ালে দেওয়ালে ছবি এঁকে এর প্রচার শুরু হয়েছে। আদিবাসী সমাজের পরিবেশ ও তাঁদের সংস্কৃতি ছবির আকারে দেওয়ালে দেওয়ালে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।  কোথাও পৌরাণিক কাহিনী , কোথাও দেবদেবীর কথা আবার কোথাও জঙ্গল থেকে গাছ কেটে নিলে কি ক্ষতি হতে পারে...... তাও ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।  এই অভিনব উদ্যোগের ফলে গ্রাম যেন এক নতুন রুপ নিয়েছে। 












এলাকার কয়েক জন যুবক মিলে , মানকর কলেজের অধ্যাপক শ্রী অর্ণব মহাশয়ের নেতৃত্বে জঙ্গল রক্ষার উদ্যোগ নিয়েছেন। তৈরি হয়েছে একটি সংগঠন যার নাম দেওয়া হয়েছে " লবনধার  অন্নপূর্ণা ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন " । কেন অন্নপূর্ণা নাম ?? স্থানীয়লোক এর ব্যাখ্যায় জানালেন...... এখানকার অনেক মানুষের জীবন জীবিকা নির্ভর করে এই জঙ্গলের উপরে। সেই কারণেই তারা তাদের সংগঠনের নামের সাথে অন্নপূর্ণা যোগ করেছেন।  সংগঠনের কাজ বনসৃজন ও জঙ্গল সংরক্ষণের প্রচার করা। কিন্ত প্রথমে শুধু প্রচার দিয়ে কিছুই কাজ হয়নি। তারপর তারা গ্রামের বেশ কয়েকটি বাড়ির দেওয়ালে জঙ্গল সংরক্ষণ নিয়ে নানান ছবি একে প্রচার শুরু করলে আঞ্চলিক মানুষের তা বেশ গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠে। গ্রামের মন্দিরগুলির দেওয়াল গুলিতে পৌরাণিক ছবি আকা হয়। আবার নতুন প্রজন্মের কাছে গ্রামের সংস্কৃতি, বনজঙ্গল সাধারণ মানুষের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ,  জঙ্গল রক্ষা করতে কি কি করনীয় ইত্যাদি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।  স্বভাবতই নতুন প্রজন্মের মধ্যে এক নতুন উৎসাহ দেখা দিয়েছে। সংগঠনের আশা সাধারণ মানুষ আরও অনেক সচেতন হবেন এবং ফলস্বরূপ জঙ্গল থেকে অবাধে গাছ কাটা বন্ধ হবে এবং গ্রীষ্মকালে জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দেবার প্রবনতাও বন্ধ হবে। এই সোসাইটির উদ্যোগে ও গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় এ বছরই "অরণ্যে অন্নপূর্ণা" প্রোগ্রামের হাত ধরে শান্তিনিকেতন, মালদহ, মেদিনীপুর,  ঝাড়খণ্ড,  উড়িষ্যা সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পেশাদার শিল্পীরা এসে চিত্র অঙ্কন করে গেছেন।  এসব দেখলে যে কোনো মানুষেরই চোখ জুড়িয়ে যাবে। সত্যি কথা বলতে কি----- অরণ্যের সৌন্দর্যেকে নূন্যতম ক্ষুন্ন  না করেও অরণ্যসুন্দরী লবনধার গ্রামের স্বাভাবিক সৌন্দর্যেকে আরও অনেক অনেক বাড়িয়ে তুলেছে। 












লবন্ধা বা লবণধার গ্রামকে নিয়ে প্রচলিত লোককাহিনি এই রকম ---:::---

প্রায় তিনশো বছর আগে আউশগ্রামের দেবশালা অঞ্চলের " রড়ডোবার " তীরে জঙ্গলে বাঁকা জায়গায় ছিল এক বিশাল এক বটগাছ। চিল আর পায়রার আস্তানা ছিল সেই গাছে। ঐ ডোবাকে ঘিরেই গড়ে ওঠে আদিবাসী পাড়া। আবার এও শোনা যায়, সত্তরের দশকে এখানকার জঙ্গলমহল হয়ে উঠেছিল নকশালদের আস্তানা। নকশাল আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে সেই সময়ে জঙ্গলমহলের বেশ কিছু আদিবাসী পরিবার বড়ডোবা তীরবর্তী জায়গায় চলে এসে বসবাস শুরু করেন। সেখানেই গড়ে ওঠে নতুন একটি আদিবাসী গ্রাম। শুধু আদিবাসী নয়, এখন অনেক জেনারেল কাষ্টের লোকের বসবাস হয়েছে। লোকমুখেই গ্রামটি লবনধার নামে পরিচিতি পায়। আজও সেই নাম রয়ে গিয়েছে গ্রামটির।












উচ্চারণে ত্রুটি বা কষ্ট বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, নাম পরিবর্তিত হয়ে উঠেছে লবনধার।   সেই নাম আজও চলে আসছে। সময়ের সাথে সাথে এই গ্রামেই সমাদর পেয়েছে  " ছবির  গ্রাম  " হিসাবে। আবার করোর কাছে লবনধার গ্রামের নতুন নামকরণ হয়েছে " আলপনা গ্রাম" হিসাবে। তবে প্রশ্ন জাগে ______ নামে কি আসে যায় ?? নামের পরিবর্তন হলেও সৌন্দর্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। ঠিকমত প্রচারের আলোয় এলে আগামীদিনে পিছিয়ে  পরা এই গ্রামটির নাম পর্যটন মানচিত্রে উঠে আসবেই আসবে। হয়তো পিছিয়ে পরা এই এলাকার চিত্র সেদিন বদলে যাবে। কিন্ত বদল যতই ঘটুক গ্রামবাসীরা অরণ্যের জঙ্গলের বদলে কংক্রিটের জঙ্গল কখনোই দেখতে চায় না। তাদের সর্বক্ষনের ইচ্ছা , জঙ্গল ঘেরা গ্রামের ঐতিহ্য গ্রামের মধ্যেই যেন ধরা থাকে। এলাকার বাসিন্দারা সবসময়ই চান এই দেওয়ালের চিত্র আঁকড়েই শান্তিনিকেতনের কাছে থাকা তাদের লবনধার গ্রাম গোটা বাংলা জুড়ে আরো পরিচিতি পাক।