Tuesday, 7 March 2023

আলপনাময় লবন্ধা


" সুন্দরী লবন্ধা " ....... আউশগ্রামের জঙ্গলমহলের পর্যটনের এক নয়া ঠিকানা ~~~~~

গ্রামের নাম লবন্ধা।  উচ্চারণ করতে সত্যিই একটু কষ্ট হয়। তাই গ্রামবাসীরা চলতি কথায় লবনধার বলে।কিন্ত কেন এমন নাম হ'ল ?? কেউ তার সদুত্তর দিতে পারে না। তবে বইতে পড়া যে কোনো গ্রাম্য পরিবেশের সাথে মিলিয়ে নিতে পারেন এই গ্রামকে। অথবা গ্রাম্যকবির লেখা যে কোনো কবিতার সাথে হুবোহুব মিল খুজে পাবেন এই গ্রাম্যের। সেখানে গ্রামের মেঠো রাস্তায় এখনও চলে গরুর গাড়ী। মরশুমে দেখতে পাবেন ধান বোঝায় গরুর গাড়ি চলছে  মাঠ থেকে ধান নিয়ে চাষির বাড়ীতে। ছোট চাষিরা তাদের ধান মাঠ থেকে বাঁকে নিয়ে চলেছে নিজের বাড়ির গোলায়। নিত্যদিন সন্ধায় রাস্তার ধুলো উড়িয়ে সারি বেধে ফেরে গবাদি পশুর দল। গ্রামের পুকুরের পাশ দিয়ে যদি আপনি যান, তবে অবশ্যই দেখতে পাবেন দল বেধে হাঁসেদের জলকেলি আর গুগলি, ছোটমাছ খাবার দৃশ্য।  দূশনহীন বাতাসে আপনি উপভোগ করতে পারবেন সুসজ্জিত এক গ্রাম্য পরিবেশ।  চতুর্দিকের গ্রাম্যছবি, আপনার চোখ জুড়িয়ে দেবে। 









বাংলার এই গ্রামের আদিবাসী রমনীরা শুধু নিজেরাই সাজেন না। নিজেদের ঘর, গৃহস্থলীও সাজাতে ভালোবাসেন।  সেজন্যই পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রাম দু নম্বর ব্লকের জঙ্গলমহলের লবনধার গ্রাম কারুর কাছে " ছবির গ্রাম " আবার কারুর কাছে " আলপনার গ্রাম  " হিসাবে পরিচিত হয়েছে। এই গ্রামের প্রতিটি দেওয়াল,  মন্দিরের দেওয়াল বা লোকের বাড়ির প্রাচীরে শোভা পায় আদিবাসী রমণী বা স্থানীয় যুবক যুবতীদের আঁকা ছবিতে। দূর দুরন্ত থেকে মানুষ ভীর জমান আলপনা বা ছবি দেখার জন্য।  ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের প্রশংসা করতে একটুও সংকোচ বোধ করেন না।









মানকর ষ্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে কিছুটা  যাবার  পর প্রধান রাস্তা ছেড়ে  দিয়ে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে শাল, সেগুন, মহুয়ার ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বেশ খানিকটা পথ যেতে যেতে আপনি পেয়ে যাবেন গ্রামটি। মনেহবে জঙ্গল পরিষ্কার করেই গ্রামটি তৈরি করা হয়েছে। গ্রামে রয়েছে প্রায় ১০০টি বাড়ি। বর্ধমানের বুদবুদের দেবশালা পঞ্চায়েতের অধীন এই গ্রাম। বিশেষ করে গাছ, জঙ্গল বাঁচাতে দেওয়ালে দেওয়ালে ছবি এঁকে এর প্রচার শুরু হয়েছে। আদিবাসী সমাজের পরিবেশ ও তাঁদের সংস্কৃতি ছবির আকারে দেওয়ালে দেওয়ালে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।  কোথাও পৌরাণিক কাহিনী , কোথাও দেবদেবীর কথা আবার কোথাও জঙ্গল থেকে গাছ কেটে নিলে কি ক্ষতি হতে পারে...... তাও ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।  এই অভিনব উদ্যোগের ফলে গ্রাম যেন এক নতুন রুপ নিয়েছে। 












এলাকার কয়েক জন যুবক মিলে , মানকর কলেজের অধ্যাপক শ্রী অর্ণব মহাশয়ের নেতৃত্বে জঙ্গল রক্ষার উদ্যোগ নিয়েছেন। তৈরি হয়েছে একটি সংগঠন যার নাম দেওয়া হয়েছে " লবনধার  অন্নপূর্ণা ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন " । কেন অন্নপূর্ণা নাম ?? স্থানীয়লোক এর ব্যাখ্যায় জানালেন...... এখানকার অনেক মানুষের জীবন জীবিকা নির্ভর করে এই জঙ্গলের উপরে। সেই কারণেই তারা তাদের সংগঠনের নামের সাথে অন্নপূর্ণা যোগ করেছেন।  সংগঠনের কাজ বনসৃজন ও জঙ্গল সংরক্ষণের প্রচার করা। কিন্ত প্রথমে শুধু প্রচার দিয়ে কিছুই কাজ হয়নি। তারপর তারা গ্রামের বেশ কয়েকটি বাড়ির দেওয়ালে জঙ্গল সংরক্ষণ নিয়ে নানান ছবি একে প্রচার শুরু করলে আঞ্চলিক মানুষের তা বেশ গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠে। গ্রামের মন্দিরগুলির দেওয়াল গুলিতে পৌরাণিক ছবি আকা হয়। আবার নতুন প্রজন্মের কাছে গ্রামের সংস্কৃতি, বনজঙ্গল সাধারণ মানুষের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ,  জঙ্গল রক্ষা করতে কি কি করনীয় ইত্যাদি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।  স্বভাবতই নতুন প্রজন্মের মধ্যে এক নতুন উৎসাহ দেখা দিয়েছে। সংগঠনের আশা সাধারণ মানুষ আরও অনেক সচেতন হবেন এবং ফলস্বরূপ জঙ্গল থেকে অবাধে গাছ কাটা বন্ধ হবে এবং গ্রীষ্মকালে জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দেবার প্রবনতাও বন্ধ হবে। এই সোসাইটির উদ্যোগে ও গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় এ বছরই "অরণ্যে অন্নপূর্ণা" প্রোগ্রামের হাত ধরে শান্তিনিকেতন, মালদহ, মেদিনীপুর,  ঝাড়খণ্ড,  উড়িষ্যা সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পেশাদার শিল্পীরা এসে চিত্র অঙ্কন করে গেছেন।  এসব দেখলে যে কোনো মানুষেরই চোখ জুড়িয়ে যাবে। সত্যি কথা বলতে কি----- অরণ্যের সৌন্দর্যেকে নূন্যতম ক্ষুন্ন  না করেও অরণ্যসুন্দরী লবনধার গ্রামের স্বাভাবিক সৌন্দর্যেকে আরও অনেক অনেক বাড়িয়ে তুলেছে। 












লবন্ধা বা লবণধার গ্রামকে নিয়ে প্রচলিত লোককাহিনি এই রকম ---:::---

প্রায় তিনশো বছর আগে আউশগ্রামের দেবশালা অঞ্চলের " রড়ডোবার " তীরে জঙ্গলে বাঁকা জায়গায় ছিল এক বিশাল এক বটগাছ। চিল আর পায়রার আস্তানা ছিল সেই গাছে। ঐ ডোবাকে ঘিরেই গড়ে ওঠে আদিবাসী পাড়া। আবার এও শোনা যায়, সত্তরের দশকে এখানকার জঙ্গলমহল হয়ে উঠেছিল নকশালদের আস্তানা। নকশাল আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে সেই সময়ে জঙ্গলমহলের বেশ কিছু আদিবাসী পরিবার বড়ডোবা তীরবর্তী জায়গায় চলে এসে বসবাস শুরু করেন। সেখানেই গড়ে ওঠে নতুন একটি আদিবাসী গ্রাম। শুধু আদিবাসী নয়, এখন অনেক জেনারেল কাষ্টের লোকের বসবাস হয়েছে। লোকমুখেই গ্রামটি লবনধার নামে পরিচিতি পায়। আজও সেই নাম রয়ে গিয়েছে গ্রামটির।












উচ্চারণে ত্রুটি বা কষ্ট বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, নাম পরিবর্তিত হয়ে উঠেছে লবনধার।   সেই নাম আজও চলে আসছে। সময়ের সাথে সাথে এই গ্রামেই সমাদর পেয়েছে  " ছবির  গ্রাম  " হিসাবে। আবার করোর কাছে লবনধার গ্রামের নতুন নামকরণ হয়েছে " আলপনা গ্রাম" হিসাবে। তবে প্রশ্ন জাগে ______ নামে কি আসে যায় ?? নামের পরিবর্তন হলেও সৌন্দর্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। ঠিকমত প্রচারের আলোয় এলে আগামীদিনে পিছিয়ে  পরা এই গ্রামটির নাম পর্যটন মানচিত্রে উঠে আসবেই আসবে। হয়তো পিছিয়ে পরা এই এলাকার চিত্র সেদিন বদলে যাবে। কিন্ত বদল যতই ঘটুক গ্রামবাসীরা অরণ্যের জঙ্গলের বদলে কংক্রিটের জঙ্গল কখনোই দেখতে চায় না। তাদের সর্বক্ষনের ইচ্ছা , জঙ্গল ঘেরা গ্রামের ঐতিহ্য গ্রামের মধ্যেই যেন ধরা থাকে। এলাকার বাসিন্দারা সবসময়ই চান এই দেওয়ালের চিত্র আঁকড়েই শান্তিনিকেতনের কাছে থাকা তাদের লবনধার গ্রাম গোটা বাংলা জুড়ে আরো পরিচিতি পাক।