Friday, 14 June 2019

টেরাকোটার গ্রাম বনকাটি, পশ্চিম বর্ধমান।

টেরাকোটার গ্রাম বনকাটি, পশ্চিম বর্ধমান।

বন কেটে বসত, তাই নাম বনকাটি। তবে বন কেটে বসত স্থাপনের সময়কালের নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না। একদল মানুষ বন-জঙ্গল সাফ করে বসত এবং আবাদের জায়গা বার করতে। তাদের " বন কাটাদের দল " বলা হতো। তাদের বসবাস থেকেই বনকাটির নাম। অবিভক্ত বর্ধমান জেলার আউশ গ্রাম এবং কাঁকসা থানার উত্তর প্রান্তিয় অজয় নদীর তীরবর্তী এই জঙ্গলভূমির নামেই অযোধ্যা-বনকাটি। অবস্থান পরিচিতি সুবিধার জন্য এই নামকরণ।

তখনকার দিনে কাঁকসা থানা এলাকার সমগ্র ভূখণ্ডই সেনপাহাড়ি নামে পরিচিত। বাংলার বিখ্যাত সেন রাজাদের নামেই সেনপাহাড়ি। লক্ষন সেন তন্ত্র সাধনার জন্য এখানে এসেছিলেন। সঙ্গে এনেছিলেন তাঁদের গুরুদেব মহেশ্বর প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে। ইনি একজন তান্ত্রিক ছিলেন। প্রচুর জমিজায়গা লাভ করে মহেশ্বর প্রসাদ এখানেই বসবাস স্থাপন করেন। বর্তমান বনকাটির রায়বাড়ি ইনারই বঙশধর। এলাকার অন্যতম প্রাচীন এই পরিবারের কালীপুজো খুবই বিখ্যাত। আবার উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যা থেকে আসা সংস্কৃত পন্ডিত ব্রাহ্মণের বসবাসের কারনে গ্রামের সেই অংশের নাম পরবর্তী কালে "অযোধ্যা" হয়।

গ্রামের প্রথমেই রয়েছে কালীতলা। নাম থেকেই বোঝা যায় এখানে একটি কালী মন্দির আছে। এই মন্দিরে গ্রামের সবলোক পূজো দেয়। একদিকে তিনটি রেখদেউল এবং এর উল্টো দিকে দুটি প্রাচীন আটচলার মন্দির। রেখদেউল গুলির প্রথম মন্দিরটির নাম গোপালেশ্বর, পরেরটির নাম উমেশ্বর আর তৃতীয় দেউলটির নাম কালীশ্বর। আটচলার মধ্যে বাঁ দিকে প্রথম মন্দিরটির নাম বিশ্বেশ্বর। দরজার খিলানের‌‌‌ উপর চমৎকার দূর্গা প্যানেল। ডানদিকের মন্দিরটির নাম উমেশেশ্বর। খিলানের উপর চমৎকার গনেশ মূর্তি শোভা পাচ্ছে। এই মন্দির গুলি যাঁরা তৈরি করেছিলেন সেই বঙশের বর্তমান উত্তর পুরুষ অনিল কুমার রায়। এখন ওঁরা রায় পদবী ব্যবহার করেন। এক বিশাল কাঁসার রেকাবির পিছনে ওদের বঙশতালিকা লেখা আছে। এই রেকাবিটা যা এখনও রয়েছে, বাকি সমস্ত বাসন কোসন ডাকাতরা নিয়ে গেছে। গুপ্ত ধনের সন্ধ্যানে মাঝে মধ্যে ডাকাতরা এখনও খোঁড়াখুঁড়ি করে। আরও দুটি দেউল আছে, মাথা অব্দি আগাছায় ঢাকা। প্রচুর সাপ আছে ঐ জঙ্গলে এবং ভাঙ্গা দেউলে। তাই সেখানে যাওয়া মানা।

আর আছে এই গ্রামের প্রাক্তন জমিদার এবং ইংরেজ আমলে গালার ব্যবসা করে ধনী‌ হয়ে ওঠা, রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত পঙ্চ রত্ন মন্দির। মন্দিরের মধ্যে আছে এক বৃহৎ শিবলিঙ্গ। মন্দিরের টেরাকোটার কাজ সত্যিই দেখবার মত। চর্মচোখে অবিশ্বাস্য। পঙ্চ রত্ন মন্দিরের পাশেই একটি টিনের চালার নীচে রাখা আছে পিতলের তৈরি এক বিস্ময়কর রথ। আকারে এত বড় আর এমন শৈল্পিক ও দৃষ্টি নন্দন রথ সচারচর দেখা যায় না। ঠাকুরও আছে পিতলের তৈরি, আছে সোনা রূপার গহনা, মুকুট ইত্যাদি। একটি রথযাত্রা কমিটি রথের দিনের সমস্ত কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ করে। এখনও পর্যন্ত পশ্চিম বঙ্গে ৪১টি পিতলের রথের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এরমধ্যে বনকাটির রথই প্রাচীনতম।

সেই কোন যুগে নন্দলাল বসু শান্তিনিকেতনের কলাভবনের ছাত্র ছাত্রীদের বনকাটিতে পাঠিয়েছিলেন এই রথের চিত্র দেখে আসতে। এঁরা মুক্তকন্ঠে এই রথের অসাধারণ চিত্রগুলির কথা বলেছেন। কলাভবনের কালো বাড়ীর ফ্রেসকোর অনুপ্রেরণা বনকাটির পিতলের রথের গায়ে খোদাই করা এই ছবি। প্রায় সত্তর বছর আগে এসেছিলেন বিশ্ব বিখ্যাত শিল্পী এবং কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজের প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ শ্রী মূকুল দে এই বনকাটি গ্রামে। এখানকার পোড়া মাটির কাজ দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান বাঙালি পর্যটক এসব স্থানে আসে না। এই সব টেরাকোটা কাজ সমৃদ্ধ মন্দির আমাদের অজ্ঞতা আর অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে। তাই উপেক্ষিত বনকাটি লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে গেছে। বাঙালিরা নিজেদের ঐতিহ্য নিয়ে কতটা উদাসীন, এটাই তার প্রমাণ।

কলকাতা থেকে যেতে হলে NH2 ধরে এসে, দার্জিলিং মোড় পার হয়ে পানাগড়-মোড়গারম হাইওয়ে ধরে নামতে হবে ইলামবাজারের কিছু আগে এগারো মাইল স্টপেজে। আর শান্তিনিকেতন থেকে এলে ইলামবাজার পার করে এগারো মাইলে নামতে হবে। মোড় থেকে রিকশা বা ভ্যানে করে যাওয়া যায় খুব কাছের অযোধ্যা-বনকাটি গ্রামে।


 J












































Wednesday, 12 June 2019

রামকেলী ধাম, মালদা।

রামকেলী ধাম, মালদা। মালদা থেকে গৌর যাবার পথে এটি একটি ছোট গ্রাম। শ্রী শ্রী মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের পদধূলিধন‍্য এই স্থান। কথিত আছে বৃন্দাবন যাত্রার সময় চৈতন্যদেব এই স্থানে কিছুদিন ছিলেন। এখানে একটি কেলিকদমব্ ও একটি তমাল গাছ আছে যার নীচে বসে তিনি সাধনা করেছিলেন। এখানেই শ্রী শ্রী চৈতন্যদেবের মন্দির স্থাপিত হয়েছে।  মন্দিরে চৈতন্যদেবের পায়ের ছাপ দেখা যায়।

এক সময় বাঙালার রাজধানী ছিল গৌর। কথিত আছে তৎকালীন গৌড়ের বাদশা হুসেন শাহের আমলে মন্ত্রীসভায় ছিলেন মহাবৈষঞব রূপ ও সনাতন গোস্বামী। তাঁরই ১৫০৯ খৃষ্টাবদে রামকেলীতে মদনমোহন মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁরা বৃন্দাবনের আদলে রামকেলিতে আটটি কুন্ড বা পুকুর খনন করেন এবং রামকেলিকে কায'ত বৃন্দাবনের রুপ দিতে চেয়েছিলেন। পরবর্তীতে রামকেলি " গুপ্ত বৃন্দাবন" নামে পরিচিতি লাভ করে। আর এই দুই মহাবৈষঞবের সাথে দেখা করতে ১৫১৫ খৃষ্টাবদের ১৫ ই জুন জৈষ্ঠ্য সংক্রান্তিতে রামমকেলিতে এসেছিলেন মহাপ্রভু চৈতন্যদেব। মহাপ্রভু ও রূপ সনাতনের এই মিলনের দিনকে ঘিরেই রামকেলি উৎসব বা মেলা হয়ে আসছে। সপ্তাহব্যাপী এই মেলা শুরু হয় জৈষ্ঠ্য সংক্রান্তিতর দিন থেকে। ৫০০ বৎসরেরও বেশি পুরনো এই মেলা। মেলার কয়েক দিনের জন্য ঘাঁটি গাড়ে দূর -দূরান্ত থেকে আসা বৈষনব বৈষ্ণবীরা। দিনভর চলে নাম সঙ্কীর্ণত।

মালদা থেকে এই স্থানের দূরত্ব প্রায় ১৪ কি মি।