Thursday, 5 November 2020

পিয়াসাড়ার সরকার জমিদার বাড়ি

 

পিয়াসাড়ার সরকার জমিদার বাড়ি *"*"*"*'*"*"*"*"*"*


পিয়াসাড়া সরকার পরিবার হুগলি জেলার অন্যতম প্রাচীন জমিদার পরিবার। তাদের নবম প্রজন্ম এখন দেবী দুর্গার উপাসনার ঐতিহ্য বজায় রেখেছে। প্রায় সাড়ে তিনশত বছরের পুরনো এই পূজো। শোনা যায় ইনাদের পূর্বপুরুষ শ্রী শরৎ চন্দ্র সরকার মহাশয় প্রথম দূর্গা পূজার প্রচলন করেন। এই জমিদার বাড়ির পূর্ব পদবী খাঁ ছিল। সিরাজদৌলার আমল থেকে খাঁ নামেই পরিচিত ছিল। পরবর্তী কালে বর্ধমানের মহারাজা সরকার উপাধি দেন এবং জমিদার বলে ভূষিত করেন। 






ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় ..... এক সময় এনারা জমিদার ছিলেন বর্ধমান রাজার অধীনে। সেই সময় এই বঙশের এক জমিদার কর দিতে না পারায় বর্ধমানের রাজা ওনাকে কারাগারে বন্দী করে রাখেন। বন্দীদশায় কিছু দিন থাকার পর জমিদারবাবু অনশন শুরু করেন এই দু:কে যে তিনি না থাকলে পিয়াসারা জমিদার বাড়িতে দূর্গাপূজো হবে না। এই খবর রাজার কানে যায়। রাজা কথা বলেন জমিদারের সাথে এবং ওনাকে ছাড়েন এক শর্তে যে ফিরে  গিয়ে দূর্গা পূজো করতে হবে। তখন মাত্র পূজোর সাতদিন বাকি। ঠাকুর এক মেটে হয়ে পরে আছে। রাজামশাই সাথে একজনকে পাঠান যিনি পুরো ব্যাপারটা দেখাশোনা করবেন। তারপর জমিদার ফিরে এলেন এবং যথারীতি মহাসমারোহে দূর্গাপূজা হ'ল। জমিদারের এমন ব্যবহার দেখে রাজা তখন জমিদারি নিষ্কর ঘোষণা করলেন এবং তারপর থেকেই সরকার বাড়ি খুব ভালোভাবে জমিদারি করতে থাকেন। 






এই বাড়ীর দূর্গা ঠাকুর চার হাত বিশিষ্ট এবং একচালা, ডাকের সাজের। এই বৈশিষ্ট্যটির জন্য অন্যান্য পূজোর থেকে এটিকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে। আগে এখানে ছাগ ও মহিষ বলি হতো। এখন এগুলি উঠে গেলেও এখন ছাঁচিকুমড়ো, আখ, আদা ও লেবু বলি হয়। এছাড়া সন্ধিপূজোতে দুটি পরাতের প্রতিটিতে এক থেকে দেড় মণ চাল ও তৎসহ আনাজ ও বিভিন্ন ফল সহ মাকে নিবেদন করা হয়। বাড়ীর কুলোদেবতা নারায়ন  ও দেবী লক্ষ্মীকে পূজোর এই কটা দিন ঠাকুর দালানে আনা হয় এবং তার পর মায়ের পূজো আরম্ভ হয়। শোনাযায় অনেক আগে দূর্গা পূজার পর বাসন্তী পূজাও জমিদার বাড়িতে হতো। এখনও এ বাড়িতে গেলে নবম পুরুষের শ্রী বিশ্বনাথ সরকার বা শ্রী অশোক সরকারের মুখে সমস্ত ইতিহাস শোনা যায়।





এই সরকার বাড়ি হরিপালের কাছে। নিকটতম ল্যান্ডমার্ক  ডানকুনি-চাপাডাঙ্গার রাস্তায় গজাড় মোর। এই মোর ছাড়িয়ে একটু এগুলে গোবরহারা হাই স্কুল। এই স্কুলের ঠিক উল্টো দিকের রাস্তা যেটা পঞ্চানন পাম্পের পাশ দিয়ে গিয়েছে সেটা দিয়ে সোজা এগুলে সরকার জমিদার বাড়িতে যাওয়া যায়।






তিড়োলের খ্যাপা কালী, আরামবাগ

 

তিড়োলের খ্যাপা কালী, আরামবাগ ********

মা কালী বিভিন্ন নামে পূজিত হন। কোথাও রখ্খাকালী, কোথাও শ্যামাকালী, আবার যখন শ্মাশানে এই দেবী পূজিত হন, তখন তাঁকে শ্মাশান কালী বলে ডাকা হয়। কিন্তু তিড়োলের এই মন্দিরে কালী পূজিত হন খ্যাপাকালী নামে। কিন্তু কেন এই নাম? কথিত আছে বছরের পর বছর ধরে এই মন্দিরে এসে মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। তাই লোকমুখে ইনি হয়ে উঠেছেন " খ্যাপাকালী "।




আরামবাগের পাঁচশত বছরের প্রাচীন তিড়োলের জমিদার পরিবার। আরামবাগ শহর থেকে মাত্র ৫ কি মি দূরে বা আরামবাগ ষ্টেশন থেকে ২ কি মি দূরে এই তিড়োল গ্রাম।  ৫০০ বছর পূর্বে চক্রবর্তী জমিদার পরিবার মহাসমারোহে প্রতি বছর দূর্গা পূজা করতেন। তাদের জমিদারিতে কালী পূজোর প্রচলন ছিল না। জমিদার দীনণাথ চক্রবর্তী স্বপ্নে সিদ্ধেশ্বরী কালীর সন্ধান পান। তিনিই মহাসমারোহে সিদ্ধেশ্বরী কালীর প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর থেকেই জমিদার পরিবার দূর্গা পূজোর পরিবর্তে কালীপুজো করে আসছেন।  দীননাথ চক্রবর্তী ছিলেন অত্যন্ত সৎ -জন  এবং প্রজা দরোদি একজন জমিদার। তিনি মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠার পর এলাকার প্রচুর দু:স্থ  অভুক্ত মানুষের মধ্যে মায়ের প্রসাদ বিতরণ করতেন। 



এই মন্দিরে নিযুক্ত পুরোহিত শ্রী কাজল চক্রবর্তী মহাশয় বঙশ পরস্পরায় এই দেবীর পূজো করে আসছেন। তাঁর থেকে জানা যায় এই মন্দিরের মা নাকি খুবই জাগ্রত। মায়ের হাতের বালা যদি মানসিক রোগীকে পরানো হয় , তাহলে তিনি নাকি সুস্থ হয়ে যান। সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর মন্দিরের সামনে অবস্থিত পুকুরে স্নান করে সেই ভালো মা কে উৎসর্গ করে তামার বালা পড়াতে হয়। বহু প্রাচীনকাল থেকেই এই প্রথা চলে আসছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অগনিত মানসিক রোগী , এই আধুনিক বিজ্ঞানের যুগেও মায়ের কাছে আসেন ও সুস্থ হয়ে উঠেন ...... এরূপ শোনা যায়। 




কালী মায়ের যে বালা তৈরি করা হয় সেই বালাও তৈরি করেন এই গ্রামেরই নির্দিষ্ট এক কর্মকার পরিবার। সেই আদিকাল থেকেই মায়ের স্বপ্নাদেশ মতই ঐ কর্মকার পরিবারের সদস্যরাই একমাত্র এই বালা তৈরি করেন। বিখ্যাত সাহিত্যিক বিভুতিভূষন বন্দোপাধ্যায় " তিরোলের বালা " নামক একটা ছোট গল্পে এই প্রাচীন মায়ের অলৌকিক ক্ষমতার কথা লিখেছেন। কথিত আছে, সারদা দেবী তাঁর বৌদি মানসিক ভারসাম্য হারালে এই মায়ের স্বরনাপন্ন হয়েছিলেন এবং মায়ের কৃপায় সুস্থও হয়েছিলেন। মা সারদা দেবীর ভাইজি রাধু মুখোপাধ্যায়ও মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন এবং তাকে নিয়েও মা সারদামনি এই মায়ের পূজো দেন। মায়ের বালা পরিয়ে রাধুও সুস্থ জীবন ফিরে পেয়েছিলেন। 



প্রতি মঙ্গলবার এই খ্যাপাকালীর কাছে পশুবলি দেওয়া হয় এবং কালীপুজোর দিনেও প্রচুর পশুবলি হয়ে থাকে। সারা বছর অসঙখ্য ভক্তের ভীড় থাকলেও কালীপূজোতে সেই ভীড় বাড়ে কয়েক গুণ। কারন সেদিন সারারাত বিশেষ তিথি ধরে মায়ের পূজো হয়। এই উপলক্ষে মন্দির চত্বরে বসে মেলা, যা দেখার জন্য পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি থেকেও প্রচুর মানুষ ভিড় করেন। এই কালীপুজোর অন্যতম বিশেষত্বই হ'ল নহবতের সানাই। মায়ের স্বপ্নাদেশ ক্রমে বাঁকুড়ার কোতলপুরের গোগরা গ্রামের সানাইবাদক মন্ডল পরিবারের সদস্যরা সানাই বাজানো শুরু করেন। আজও মায়ের প্রিয় নহবত সানাই বাজানো হয় যা বঙশানুক্রমে এখনও বাজিয়ে আসেন সেই পরিবারের সদস্যরা। তাদের কিন্তু কোনো নিমন্ত্রন করা হয় না।



এই মায়ের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হ'ল ------- ধনিয়াখালির জমিদার, বিশ্বাস পরিবারের দূর্গা পূজোর পর দূর্গা মায়ের মুকুটটি প্রতি বছর কালীপুজোতে তিড়োলের সিদ্ধেশ্বরী মায়ের মাথায় স্থান পায়। মায়ের নির্দেশেই নাকি এমন ঘটনা ঘটে। ফলে এই দুই জমিদার পরিবারের মধ্যে এক সৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।




শুধু মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীই নয়, এখানে সুস্থ হয়ে উঠেন মৃগীরোগীরাও। তাই তিড়োল গ্রামের এই দেবী শুধু এলাকারই নয়, হয়ে উঠেছে গোটা রাজ্যের দেবী।

Friday, 3 April 2020

জামালপুরের বাবা ‌ বুড়োরাজ শিব

#জামালপুরের বিখ্যাত বাবা বুড়োরাজ শিবের কথা ********

বর্ধমান জেলার অন্তর্গত পূর্বস্থলী থানার অধীন "জামালপুর" একটি ছোট্ট গ্রাম। গঙ্গার গতি পরিবর্তনের পূর্বে যখন নবদ্বীপের পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে গঙ্গা প্রবাহিত হতো, তখন তার পূর্বেই ছিল এই গ্রাম।  জামালপুর গ্রাম শ্রী শ্রী বুড়োরাজ শিবঠাকুরের জন্য বিখ্যাত। বুড়োরাজ এই অঞ্চলের আঞ্চলিক দেবতা হিসেবে পরিচিত। এখানে এক মন্দিরে শিব ও ধর্ম রাজের পূজো হতে দেখা যায়। রাঢ় অঞ্চলে শিব পূজোর পাশাপাশি ধর্মরাজ ঠাকুরের পূজোর এক প্রাচীন প্রথা প্রচলন ছিল। এই দুই ঠাকুরের মিলিত প্রভাবেই বুড়োরাজ ঠাকুরের সৃষ্টি হয়েছে। এখেত্রে বুড়ো অর্থ শিব এবং রাজ অর্থ ধর্মরাজকেই বোঝানো হয় বলে মনে হয়। সাধারণত 'নাথ' বা 'ঈশ্বর' যোগ করেই শিবের নামকরণ হয় এদেশে , 'রাজ' দিয়ে হয় না। কিন্তু জামালপুরে হয়েছে। কারন এখানে দুই দেবতা মিলিত হয়ে সর্বজন পূজ্য লোক দেবতায় পরিনত হয়েছেন।

আনুমানিক ছ শো বছর আগে এই অঞ্চল ঘন জঙ্গলে ঢাকা ছিল। সেই জঙ্গলে ছিল একটা উইয়ের ঢিপি। শোনা যায় প্রতিদিন একটা গাই সেই উইয়ের ঢিপির উপর এসে দাড়াতো। আর তখনই আপনা থেকেই উইয়ের ঢিপির উপর দুধ পড়ত। সেই গরুর মালিক যদু ঘোষ একদিন তার পিছু নিয়ে এই আশ্চর্য ঘটনা দেখে অবাক হয়েছিলেন। রাতে স্বপ্ন দেখেন যে, ওখানেই দেবতার বাস। পরদিন সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে শিবলিঙ্গ- গৌরিপট্ট সমেত পাথরের অদ্ভুত এক বিগ্রহ পাওয়া যায়। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও সেই বিগ্রহের শেষ পাওয়া যায়নি বলে সেটি সরানো সম্ভব হয়নি। সেদিন রাতে যদু ঘোষ ফের এবং ঐ গ্রামের ব্রাহ্মন মধুসূদন চট্টপাধ্যায় স্বপ্নাদেশ পান যে, সেই বিগ্রহটি ওই স্থান থেকে সরানো অসম্ভব। তাই সেখানেই তাঁকে প্রতিষ্ঠা করে তিন সেরা চাল আর দুধ দিয়ে নিত্য পূজো করলেই হবে। সেই থেকে প্রতিদিন একটি থালায় তিন সের চালের নৈবেদ্য দিয়ে পুজো হয়। আর মাঝখানে একটা দাগ দেওয়া হয়। একাংশ শিবের উদ্দেশ্যে আর এক ভাগ যম-ধরম্ররাজের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। তবে বিশেষ তিথিতে পরামান্ন ভোগ হয়। মূলত অনার্য এবং বৌদ্ধ সংস্কৃতির মেলবন্ধনেই নাকি বাংলায় ধর্ম পূজার প্রচলন হয়ে ছিল। প্রচলিত কাহিনী অনুসারে সেই বারহ্মন বুদ্ধপূরনিমার দিনেই স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। তাই প্রতি বছর এই দিনটিতে এখানে বিরাট মেলা বসে। অসংখ্য পাঁঠা ও ভেড়া বলি হয়। মাঝে মধ্যেই বলির পাঁঠার ভাগ নিয়ে বা কে আগে বলি দেবে তা নিয়ে মারামারিও বেঁধে যায়। ভেসে উঠে আদিম সমাজের ছবি। বিপদে পড়ে বা কোনোও গভীর সমস্যা থেকে মুক্তি পেতেই মানুষ দেবতার কাছে কিছু মানত করে। বিপন্ন মুক্ত হলে তারা এই ধর্ম রাজের কাছে দেবতার উদ্দেশ্যে পশুবলি দেয়।

পূর্বমুখী বুড়োরাজের মন্দিরটি ইট পাথরের মন্দির নয়। মন্দিরের চাল খড়ের চারচালা ও মেঝে মাটির। পাকা মন্দির করা দেবতার নিষেধ বলে কথিত। মন্দিরের সামনে চাঁদনী আকৃতির নাটমন্দির । বহুকাল আগে পাটুলীর জমিদার চারুচন্দ্র সাহা রোগমুক্তির পর এই নাটমন্দিরটি নির্মাণ করে দেন। পরে অবশ্য কয়েক বার সংস্কার করা হয়। সন্তান বা অন্য কিছুর কামনায় ভক্তরা মন্দিরের পাশের অশ্বত্থ গাছের ডালে নুড়ি বেঁধে দেন।কামনা পূর্ন হলে বাবার পূজো দিয়ে নুড়ি খুলে যান। অনেকে মনস্কামনায় বাবার মাথায় ফুল চড়ান। বাবার মাথা থেকে ফুল পড়ে গেলে মনস্কামনা সম্পর্কে নিশ্চিত আদেশ জানা যায়। কঠিন ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে অনেকে দন্ডি কাটার মানসিক করেন। রোগমুক্তির পর বাবার পুকুরে স্নান করে ভিজা কাপড়ে মন্দির পর্যন্ত দন্ডি কাটেন। শিবের গাজনের মত বুড়োরাজের গাজন চৈত্র মাসে হয় না। বৈশাখী পূর্ণিমায় বুড়োরাজের গাজন হয়। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যে কেউ সন্ন্যাসী হতে পারেন ‌। সন্ন্যাসী কে এক মাস ধরে হবিষ্যান্ন খেতে হয়। আবার শিবরাত্রিতেও মন্দিরে সারারাত পূজাপাঠ হয় ও প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়।

বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন যে মেলা বসে তা চলে প্রায় এক মাস ধরে। স্থায়ী দোকানের পাশাপাশি অস্থায়ী দোকানও বসে। দোকানীরা আসেন কলকাতা, শান্তিপুর, নবদ্বীপ, অগ্রদ্বীপ, বর্ধমান, কালনা, কাটোয়া থেকে। এখানে কেউ বা আসেন ভক্তিতে, কেউ বা আসেন মেলার আকর্ষণে। "বুড়োরাজের জয়" ধ্বনিতে মুখরিত হয় আকাশ বাতাস। আজও সরল মানুষের বিশ্বাস ______ বুড়োরাজের দরবারে এসে বোবার মুখে কথা ফোটে, দৃষ্টি হীন দৃষ্টি ফিরে পায়, দুরারোগ্য ব্যাধির নিরাময় হয় কিংবা নি: সন্তান সন্তান সম্ভাবা হয়। আর এই বিশ্বাস নিয়ে হাজার হাজার মানুষ এই সময় সন্ন্যাস পালন করে। তাই সরল ধর্মীয় বিশ্বাস আর লৌকিক কিংবদন্তির মাঝে আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল জামালপুরের বুড়োরাজ।


হাওড়া-কাটোয় বা শিয়ালদহ-কাটোয়া রেলপথের পাটুলি স্টেশন থেকে ৭ কিমি দূরে এই জামালপুর গ্রাম। পাটুলি স্টেশন থেকে টোটো বা অটোতে সহজেই যাওয়া যায়। হাওড়া থেকে দূরত্ব ১২৭ কিমি। আর পূর্বস্থলী থেকে ১৬  কিমি দূরে।

বর্ধমান জেলার অন্তর্গত পূর্বস্থলী থানার অধীন "জামালপুর" একটি ছোট্ট গ্রাম। গঙ্গার গতি পরিবর্তনের পূর্বে যখন নবদ্বীপের পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে গঙ্গা প্রবাহিত হতো, তখন তার পূর্বেই ছিল এই গ্রাম।  জামালপুর গ্রাম শ্রী শ্রী বুড়োরাজ শিবঠাকুরের জন্য বিখ্যাত। বুড়োরাজ এই অঞ্চলের আঞ্চলিক দেবতা হিসেবে পরিচিত। এখানে এক মন্দিরে শিব ও ধর্ম রাজের পূজো হতে দেখা যায়। রাঢ় অঞ্চলে শিব পূজোর পাশাপাশি ধর্মরাজ ঠাকুরের পূজোর এক প্রাচীন প্রথা প্রচলন ছিল। এই দুই ঠাকুরের মিলিত প্রভাবেই বুড়োরাজ ঠাকুরের সৃষ্টি হয়েছে। এখেত্রে বুড়ো অর্থ শিব এবং রাজ অর্থ ধর্মরাজকেই বোঝানো হয় বলে মনে হয়। সাধারণত 'নাথ' বা 'ঈশ্বর' যোগ করেই শিবের নামকরণ হয় এদেশে , 'রাজ' দিয়ে হয় না। কিন্তু জামালপুরে হয়েছে। কারন এখানে দুই দেবতা মিলিত হয়ে সর্বজন পূজ্য লোক দেবতায় পরিনত হয়েছেন।

আনুমানিক ছ শো বছর আগে এই অঞ্চল ঘন জঙ্গলে ঢাকা ছিল। সেই জঙ্গলে ছিল একটা উইয়ের ঢিপি। শোনা যায় প্রতিদিন একটা গাই সেই উইয়ের ঢিপির উপর এসে দাড়াতো। আর তখনই আপনা থেকেই উইয়ের ঢিপির উপর দুধ পড়ত। সেই গরুর মালিক যদু ঘোষ একদিন তার পিছু নিয়ে এই আশ্চর্য ঘটনা দেখে অবাক হয়েছিলেন। রাতে স্বপ্ন দেখেন যে, ওখানেই দেবতার বাস। পরদিন সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে শিবলিঙ্গ- গৌরিপট্ট সমেত পাথরের অদ্ভুত এক বিগ্রহ পাওয়া যায়। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও সেই বিগ্রহের শেষ পাওয়া যায়নি বলে সেটি সরানো সম্ভব হয়নি। সেদিন রাতে যদু ঘোষ ফের এবং ঐ গ্রামের ব্রাহ্মন মধুসূদন চট্টপাধ্যায় স্বপ্নাদেশ পান যে, সেই বিগ্রহটি ওই স্থান থেকে সরানো অসম্ভব। তাই সেখানেই তাঁকে প্রতিষ্ঠা করে তিন সেরা চাল আর দুধ দিয়ে নিত্য পূজো করলেই হবে। সেই থেকে প্রতিদিন একটি থালায় তিন সের চালের নৈবেদ্য দিয়ে পুজো হয়। আর মাঝখানে একটা দাগ দেওয়া হয়। একাংশ শিবের উদ্দেশ্যে আর এক ভাগ যম-ধরম্ররাজের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। তবে বিশেষ তিথিতে পরামান্ন ভোগ হয়। মূলত অনার্য এবং বৌদ্ধ সংস্কৃতির মেলবন্ধনেই নাকি বাংলায় ধর্ম পূজার প্রচলন হয়ে ছিল। প্রচলিত কাহিনী অনুসারে সেই বারহ্মন বুদ্ধপূরনিমার দিনেই স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। তাই প্রতি বছর এই দিনটিতে এখানে বিরাট মেলা বসে। অসংখ্য পাঁঠা ও ভেড়া বলি হয়। মাঝে মধ্যেই বলির পাঁঠার ভাগ নিয়ে বা কে আগে বলি দেবে তা নিয়ে মারামারিও বেঁধে যায়। ভেসে উঠে আদিম সমাজের ছবি। বিপদে পড়ে বা কোনোও গভীর সমস্যা থেকে মুক্তি পেতেই মানুষ দেবতার কাছে কিছু মানত করে। বিপন্ন মুক্ত হলে তারা এই ধর্ম রাজের কাছে দেবতার উদ্দেশ্যে পশুবলি দেয়।

পূর্বমুখী বুড়োরাজের মন্দিরটি ইট পাথরের মন্দির নয়। মন্দিরের চাল খড়ের চারচালা ও মেঝে মাটির। পাকা মন্দির করা দেবতার নিষেধ বলে কথিত। মন্দিরের সামনে চাঁদনী আকৃতির নাটমন্দির । বহুকাল আগে পাটুলীর জমিদার চারুচন্দ্র সাহা রোগমুক্তির পর এই নাটমন্দিরটি নির্মাণ করে দেন। পরে অবশ্য কয়েক বার সংস্কার করা হয়। সন্তান বা অন্য কিছুর কামনায় ভক্তরা মন্দিরের পাশের অশ্বত্থ গাছের ডালে নুড়ি বেঁধে দেন।কামনা পূর্ন হলে বাবার পূজো দিয়ে নুড়ি খুলে যান। অনেকে মনস্কামনায় বাবার মাথায় ফুল চড়ান। বাবার মাথা থেকে ফুল পড়ে গেলে মনস্কামনা সম্পর্কে নিশ্চিত আদেশ জানা যায়। কঠিন ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে অনেকে দন্ডি কাটার মানসিক করেন। রোগমুক্তির পর বাবার পুকুরে স্নান করে ভিজা কাপড়ে মন্দির পর্যন্ত দন্ডি কাটেন। শিবের গাজনের মত বুড়োরাজের গাজন চৈত্র মাসে হয় না। বৈশাখী পূর্ণিমায় বুড়োরাজের গাজন হয়। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যে কেউ সন্ন্যাসী হতে পারেন ‌। সন্ন্যাসী কে এক মাস ধরে হবিষ্যান্ন খেতে হয়। আবার শিবরাত্রিতেও মন্দিরে সারারাত পূজাপাঠ হয় ও প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়।

বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন যে মেলা বসে তা চলে প্রায় এক মাস ধরে। স্থায়ী দোকানের পাশাপাশি অস্থায়ী দোকানও বসে। দোকানীরা আসেন কলকাতা, শান্তিপুর, নবদ্বীপ, অগ্রদ্বীপ, বর্ধমান, কালনা, কাটোয়া থেকে। এখানে কেউ বা আসেন ভক্তিতে, কেউ বা আসেন মেলার আকর্ষণে। "বুড়োরাজের জয়" ধ্বনিতে মুখরিত হয় আকাশ বাতাস। আজও সরল মানুষের বিশ্বাস ______ বুড়োরাজের দরবারে এসে বোবার মুখে কথা ফোটে, দৃষ্টি হীন দৃষ্টি ফিরে পায়, দুরারোগ্য ব্যাধির নিরাময় হয় কিংবা নি: সন্তান সন্তান সম্ভাবা হয়। আর এই বিশ্বাস নিয়ে হাজার হাজার মানুষ এই সময় সন্ন্যাস পালন করে। তাই সরল ধর্মীয় বিশ্বাস আর লৌকিক কিংবদন্তির মাঝে আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল জামালপুরের বুড়োরাজ।

হাওড়া-কাটোয় বা শিয়ালদহ-কাটোয়া রেলপথের পাটুলি স্টেশন থেকে ৭ কিমি দূরে এই জামালপুর গ্রাম। পাটুলি স্টেশন থেকে টোটো বা অটোতে সহজেই যাওয়া যায়। হাওড়া থেকে দূরত্ব ১২৭ কিমি। আর পূর্বস্থলী থেকে ১৬  কিমি দূরে।

মন্দিরের সামনেই রয়েছে নাটমন্দির 

মন্দিরের ভেতরে পূজো দেবার কাজ চলছে


পুকুর থেকে স্নান সেরে দন্ডি কাটা চলছে

 মাটির নীচে বাবা রয়েছেন

বাবা বুড়োরাজ শিবের মন্দির

মন্দির অঞ্চলের স্থায়ী দোকান


মানতের ঢিল বাধা বটগাছ

মন্দিরের দুই প্রধান পুরোহিত

ফকির বাবার আশীর্বাদ


মন্দির এলাকার দোকানপাট