Friday, 3 April 2020

জামালপুরের বাবা ‌ বুড়োরাজ শিব

#জামালপুরের বিখ্যাত বাবা বুড়োরাজ শিবের কথা ********

বর্ধমান জেলার অন্তর্গত পূর্বস্থলী থানার অধীন "জামালপুর" একটি ছোট্ট গ্রাম। গঙ্গার গতি পরিবর্তনের পূর্বে যখন নবদ্বীপের পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে গঙ্গা প্রবাহিত হতো, তখন তার পূর্বেই ছিল এই গ্রাম।  জামালপুর গ্রাম শ্রী শ্রী বুড়োরাজ শিবঠাকুরের জন্য বিখ্যাত। বুড়োরাজ এই অঞ্চলের আঞ্চলিক দেবতা হিসেবে পরিচিত। এখানে এক মন্দিরে শিব ও ধর্ম রাজের পূজো হতে দেখা যায়। রাঢ় অঞ্চলে শিব পূজোর পাশাপাশি ধর্মরাজ ঠাকুরের পূজোর এক প্রাচীন প্রথা প্রচলন ছিল। এই দুই ঠাকুরের মিলিত প্রভাবেই বুড়োরাজ ঠাকুরের সৃষ্টি হয়েছে। এখেত্রে বুড়ো অর্থ শিব এবং রাজ অর্থ ধর্মরাজকেই বোঝানো হয় বলে মনে হয়। সাধারণত 'নাথ' বা 'ঈশ্বর' যোগ করেই শিবের নামকরণ হয় এদেশে , 'রাজ' দিয়ে হয় না। কিন্তু জামালপুরে হয়েছে। কারন এখানে দুই দেবতা মিলিত হয়ে সর্বজন পূজ্য লোক দেবতায় পরিনত হয়েছেন।

আনুমানিক ছ শো বছর আগে এই অঞ্চল ঘন জঙ্গলে ঢাকা ছিল। সেই জঙ্গলে ছিল একটা উইয়ের ঢিপি। শোনা যায় প্রতিদিন একটা গাই সেই উইয়ের ঢিপির উপর এসে দাড়াতো। আর তখনই আপনা থেকেই উইয়ের ঢিপির উপর দুধ পড়ত। সেই গরুর মালিক যদু ঘোষ একদিন তার পিছু নিয়ে এই আশ্চর্য ঘটনা দেখে অবাক হয়েছিলেন। রাতে স্বপ্ন দেখেন যে, ওখানেই দেবতার বাস। পরদিন সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে শিবলিঙ্গ- গৌরিপট্ট সমেত পাথরের অদ্ভুত এক বিগ্রহ পাওয়া যায়। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও সেই বিগ্রহের শেষ পাওয়া যায়নি বলে সেটি সরানো সম্ভব হয়নি। সেদিন রাতে যদু ঘোষ ফের এবং ঐ গ্রামের ব্রাহ্মন মধুসূদন চট্টপাধ্যায় স্বপ্নাদেশ পান যে, সেই বিগ্রহটি ওই স্থান থেকে সরানো অসম্ভব। তাই সেখানেই তাঁকে প্রতিষ্ঠা করে তিন সেরা চাল আর দুধ দিয়ে নিত্য পূজো করলেই হবে। সেই থেকে প্রতিদিন একটি থালায় তিন সের চালের নৈবেদ্য দিয়ে পুজো হয়। আর মাঝখানে একটা দাগ দেওয়া হয়। একাংশ শিবের উদ্দেশ্যে আর এক ভাগ যম-ধরম্ররাজের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। তবে বিশেষ তিথিতে পরামান্ন ভোগ হয়। মূলত অনার্য এবং বৌদ্ধ সংস্কৃতির মেলবন্ধনেই নাকি বাংলায় ধর্ম পূজার প্রচলন হয়ে ছিল। প্রচলিত কাহিনী অনুসারে সেই বারহ্মন বুদ্ধপূরনিমার দিনেই স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। তাই প্রতি বছর এই দিনটিতে এখানে বিরাট মেলা বসে। অসংখ্য পাঁঠা ও ভেড়া বলি হয়। মাঝে মধ্যেই বলির পাঁঠার ভাগ নিয়ে বা কে আগে বলি দেবে তা নিয়ে মারামারিও বেঁধে যায়। ভেসে উঠে আদিম সমাজের ছবি। বিপদে পড়ে বা কোনোও গভীর সমস্যা থেকে মুক্তি পেতেই মানুষ দেবতার কাছে কিছু মানত করে। বিপন্ন মুক্ত হলে তারা এই ধর্ম রাজের কাছে দেবতার উদ্দেশ্যে পশুবলি দেয়।

পূর্বমুখী বুড়োরাজের মন্দিরটি ইট পাথরের মন্দির নয়। মন্দিরের চাল খড়ের চারচালা ও মেঝে মাটির। পাকা মন্দির করা দেবতার নিষেধ বলে কথিত। মন্দিরের সামনে চাঁদনী আকৃতির নাটমন্দির । বহুকাল আগে পাটুলীর জমিদার চারুচন্দ্র সাহা রোগমুক্তির পর এই নাটমন্দিরটি নির্মাণ করে দেন। পরে অবশ্য কয়েক বার সংস্কার করা হয়। সন্তান বা অন্য কিছুর কামনায় ভক্তরা মন্দিরের পাশের অশ্বত্থ গাছের ডালে নুড়ি বেঁধে দেন।কামনা পূর্ন হলে বাবার পূজো দিয়ে নুড়ি খুলে যান। অনেকে মনস্কামনায় বাবার মাথায় ফুল চড়ান। বাবার মাথা থেকে ফুল পড়ে গেলে মনস্কামনা সম্পর্কে নিশ্চিত আদেশ জানা যায়। কঠিন ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে অনেকে দন্ডি কাটার মানসিক করেন। রোগমুক্তির পর বাবার পুকুরে স্নান করে ভিজা কাপড়ে মন্দির পর্যন্ত দন্ডি কাটেন। শিবের গাজনের মত বুড়োরাজের গাজন চৈত্র মাসে হয় না। বৈশাখী পূর্ণিমায় বুড়োরাজের গাজন হয়। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যে কেউ সন্ন্যাসী হতে পারেন ‌। সন্ন্যাসী কে এক মাস ধরে হবিষ্যান্ন খেতে হয়। আবার শিবরাত্রিতেও মন্দিরে সারারাত পূজাপাঠ হয় ও প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়।

বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন যে মেলা বসে তা চলে প্রায় এক মাস ধরে। স্থায়ী দোকানের পাশাপাশি অস্থায়ী দোকানও বসে। দোকানীরা আসেন কলকাতা, শান্তিপুর, নবদ্বীপ, অগ্রদ্বীপ, বর্ধমান, কালনা, কাটোয়া থেকে। এখানে কেউ বা আসেন ভক্তিতে, কেউ বা আসেন মেলার আকর্ষণে। "বুড়োরাজের জয়" ধ্বনিতে মুখরিত হয় আকাশ বাতাস। আজও সরল মানুষের বিশ্বাস ______ বুড়োরাজের দরবারে এসে বোবার মুখে কথা ফোটে, দৃষ্টি হীন দৃষ্টি ফিরে পায়, দুরারোগ্য ব্যাধির নিরাময় হয় কিংবা নি: সন্তান সন্তান সম্ভাবা হয়। আর এই বিশ্বাস নিয়ে হাজার হাজার মানুষ এই সময় সন্ন্যাস পালন করে। তাই সরল ধর্মীয় বিশ্বাস আর লৌকিক কিংবদন্তির মাঝে আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল জামালপুরের বুড়োরাজ।


হাওড়া-কাটোয় বা শিয়ালদহ-কাটোয়া রেলপথের পাটুলি স্টেশন থেকে ৭ কিমি দূরে এই জামালপুর গ্রাম। পাটুলি স্টেশন থেকে টোটো বা অটোতে সহজেই যাওয়া যায়। হাওড়া থেকে দূরত্ব ১২৭ কিমি। আর পূর্বস্থলী থেকে ১৬  কিমি দূরে।

বর্ধমান জেলার অন্তর্গত পূর্বস্থলী থানার অধীন "জামালপুর" একটি ছোট্ট গ্রাম। গঙ্গার গতি পরিবর্তনের পূর্বে যখন নবদ্বীপের পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে গঙ্গা প্রবাহিত হতো, তখন তার পূর্বেই ছিল এই গ্রাম।  জামালপুর গ্রাম শ্রী শ্রী বুড়োরাজ শিবঠাকুরের জন্য বিখ্যাত। বুড়োরাজ এই অঞ্চলের আঞ্চলিক দেবতা হিসেবে পরিচিত। এখানে এক মন্দিরে শিব ও ধর্ম রাজের পূজো হতে দেখা যায়। রাঢ় অঞ্চলে শিব পূজোর পাশাপাশি ধর্মরাজ ঠাকুরের পূজোর এক প্রাচীন প্রথা প্রচলন ছিল। এই দুই ঠাকুরের মিলিত প্রভাবেই বুড়োরাজ ঠাকুরের সৃষ্টি হয়েছে। এখেত্রে বুড়ো অর্থ শিব এবং রাজ অর্থ ধর্মরাজকেই বোঝানো হয় বলে মনে হয়। সাধারণত 'নাথ' বা 'ঈশ্বর' যোগ করেই শিবের নামকরণ হয় এদেশে , 'রাজ' দিয়ে হয় না। কিন্তু জামালপুরে হয়েছে। কারন এখানে দুই দেবতা মিলিত হয়ে সর্বজন পূজ্য লোক দেবতায় পরিনত হয়েছেন।

আনুমানিক ছ শো বছর আগে এই অঞ্চল ঘন জঙ্গলে ঢাকা ছিল। সেই জঙ্গলে ছিল একটা উইয়ের ঢিপি। শোনা যায় প্রতিদিন একটা গাই সেই উইয়ের ঢিপির উপর এসে দাড়াতো। আর তখনই আপনা থেকেই উইয়ের ঢিপির উপর দুধ পড়ত। সেই গরুর মালিক যদু ঘোষ একদিন তার পিছু নিয়ে এই আশ্চর্য ঘটনা দেখে অবাক হয়েছিলেন। রাতে স্বপ্ন দেখেন যে, ওখানেই দেবতার বাস। পরদিন সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে শিবলিঙ্গ- গৌরিপট্ট সমেত পাথরের অদ্ভুত এক বিগ্রহ পাওয়া যায়। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও সেই বিগ্রহের শেষ পাওয়া যায়নি বলে সেটি সরানো সম্ভব হয়নি। সেদিন রাতে যদু ঘোষ ফের এবং ঐ গ্রামের ব্রাহ্মন মধুসূদন চট্টপাধ্যায় স্বপ্নাদেশ পান যে, সেই বিগ্রহটি ওই স্থান থেকে সরানো অসম্ভব। তাই সেখানেই তাঁকে প্রতিষ্ঠা করে তিন সেরা চাল আর দুধ দিয়ে নিত্য পূজো করলেই হবে। সেই থেকে প্রতিদিন একটি থালায় তিন সের চালের নৈবেদ্য দিয়ে পুজো হয়। আর মাঝখানে একটা দাগ দেওয়া হয়। একাংশ শিবের উদ্দেশ্যে আর এক ভাগ যম-ধরম্ররাজের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। তবে বিশেষ তিথিতে পরামান্ন ভোগ হয়। মূলত অনার্য এবং বৌদ্ধ সংস্কৃতির মেলবন্ধনেই নাকি বাংলায় ধর্ম পূজার প্রচলন হয়ে ছিল। প্রচলিত কাহিনী অনুসারে সেই বারহ্মন বুদ্ধপূরনিমার দিনেই স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। তাই প্রতি বছর এই দিনটিতে এখানে বিরাট মেলা বসে। অসংখ্য পাঁঠা ও ভেড়া বলি হয়। মাঝে মধ্যেই বলির পাঁঠার ভাগ নিয়ে বা কে আগে বলি দেবে তা নিয়ে মারামারিও বেঁধে যায়। ভেসে উঠে আদিম সমাজের ছবি। বিপদে পড়ে বা কোনোও গভীর সমস্যা থেকে মুক্তি পেতেই মানুষ দেবতার কাছে কিছু মানত করে। বিপন্ন মুক্ত হলে তারা এই ধর্ম রাজের কাছে দেবতার উদ্দেশ্যে পশুবলি দেয়।

পূর্বমুখী বুড়োরাজের মন্দিরটি ইট পাথরের মন্দির নয়। মন্দিরের চাল খড়ের চারচালা ও মেঝে মাটির। পাকা মন্দির করা দেবতার নিষেধ বলে কথিত। মন্দিরের সামনে চাঁদনী আকৃতির নাটমন্দির । বহুকাল আগে পাটুলীর জমিদার চারুচন্দ্র সাহা রোগমুক্তির পর এই নাটমন্দিরটি নির্মাণ করে দেন। পরে অবশ্য কয়েক বার সংস্কার করা হয়। সন্তান বা অন্য কিছুর কামনায় ভক্তরা মন্দিরের পাশের অশ্বত্থ গাছের ডালে নুড়ি বেঁধে দেন।কামনা পূর্ন হলে বাবার পূজো দিয়ে নুড়ি খুলে যান। অনেকে মনস্কামনায় বাবার মাথায় ফুল চড়ান। বাবার মাথা থেকে ফুল পড়ে গেলে মনস্কামনা সম্পর্কে নিশ্চিত আদেশ জানা যায়। কঠিন ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে অনেকে দন্ডি কাটার মানসিক করেন। রোগমুক্তির পর বাবার পুকুরে স্নান করে ভিজা কাপড়ে মন্দির পর্যন্ত দন্ডি কাটেন। শিবের গাজনের মত বুড়োরাজের গাজন চৈত্র মাসে হয় না। বৈশাখী পূর্ণিমায় বুড়োরাজের গাজন হয়। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যে কেউ সন্ন্যাসী হতে পারেন ‌। সন্ন্যাসী কে এক মাস ধরে হবিষ্যান্ন খেতে হয়। আবার শিবরাত্রিতেও মন্দিরে সারারাত পূজাপাঠ হয় ও প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়।

বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন যে মেলা বসে তা চলে প্রায় এক মাস ধরে। স্থায়ী দোকানের পাশাপাশি অস্থায়ী দোকানও বসে। দোকানীরা আসেন কলকাতা, শান্তিপুর, নবদ্বীপ, অগ্রদ্বীপ, বর্ধমান, কালনা, কাটোয়া থেকে। এখানে কেউ বা আসেন ভক্তিতে, কেউ বা আসেন মেলার আকর্ষণে। "বুড়োরাজের জয়" ধ্বনিতে মুখরিত হয় আকাশ বাতাস। আজও সরল মানুষের বিশ্বাস ______ বুড়োরাজের দরবারে এসে বোবার মুখে কথা ফোটে, দৃষ্টি হীন দৃষ্টি ফিরে পায়, দুরারোগ্য ব্যাধির নিরাময় হয় কিংবা নি: সন্তান সন্তান সম্ভাবা হয়। আর এই বিশ্বাস নিয়ে হাজার হাজার মানুষ এই সময় সন্ন্যাস পালন করে। তাই সরল ধর্মীয় বিশ্বাস আর লৌকিক কিংবদন্তির মাঝে আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল জামালপুরের বুড়োরাজ।

হাওড়া-কাটোয় বা শিয়ালদহ-কাটোয়া রেলপথের পাটুলি স্টেশন থেকে ৭ কিমি দূরে এই জামালপুর গ্রাম। পাটুলি স্টেশন থেকে টোটো বা অটোতে সহজেই যাওয়া যায়। হাওড়া থেকে দূরত্ব ১২৭ কিমি। আর পূর্বস্থলী থেকে ১৬  কিমি দূরে।

মন্দিরের সামনেই রয়েছে নাটমন্দির 

মন্দিরের ভেতরে পূজো দেবার কাজ চলছে


পুকুর থেকে স্নান সেরে দন্ডি কাটা চলছে

 মাটির নীচে বাবা রয়েছেন

বাবা বুড়োরাজ শিবের মন্দির

মন্দির অঞ্চলের স্থায়ী দোকান


মানতের ঢিল বাধা বটগাছ

মন্দিরের দুই প্রধান পুরোহিত

ফকির বাবার আশীর্বাদ


মন্দির এলাকার দোকানপাট


No comments:

Post a Comment