ভ্রামরীদেবী দর্শন -- শক্তিপীঠ ত্রিস্রোতা
ভ্রমরী দেবী মন্দির পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার ধূপগুড়ি ব্লকের তিস্তা নদীর তীরে পুরানো শালবাড়িতে অবস্থিত। মন্দিরটি নদীর তিন স্রোতের মধ্যে অবস্থান করছে বলে একে "ত্রিস্রোতা" বলা হয়। করোতোয়া, তিস্তা, জাঠোদা---- এই তিন নদীর ধারার মধ্যে এই পীঠস্থান।পর্বতীরূপী দুর্গাদেবীর ভিন্ন ভিন্ন অবতার সমূহ হল ---- কালিকা, নন্দা, ভ্রামরী, শাকম্ভরী, রক্তদন্ডিকা, কৌশিক ইত্যাদি। এখানে দেবীর নাম ভ্রামরী। ভ্রামরী-র অর্থ হল মহিলা মৌমাছি রূপে মা দেবী দূর্গা। ভৈরবের নাম ঈশ্বর বা জল্পেশ। ভৈরব জল্পেশ জল্পেশ মন্দিরে অবস্থান করছেন। একান্নপীঠের মধ্যে "ত্রিস্রোতা" হল এক শক্তিপীঠ। মন্দিরটি তৈরির সঠিক তারিখ এখনও অজানা । কারণ এটি এমন এক শক্তিপীঠ যা বহু শতাব্দী পূর্বে তৈরি হয়েছিল।
বিভিন্ন শাস্ত্র ও পুরাণ কাহিনীতে লেখা কাহিনীগুলি পড়লে আমরা জানতে পারি যে স্বর্গের আধিপত্য নিয়ে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে বিবাদ ও যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। "দেবী ভাগবত পুরাণ", "দেবী পুরাণ" প্রভৃতি গ্রণ্থে দেবী ভ্রামরী মাতার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।
অরুণাসুর নামে এক অসুর দেবতাদের পরাস্ত করে স্বর্গরাজ্য অধিকার করার সংকল্প করে। তার বাসনা অনুযায়ী প্রভূ ব্রহ্মাকে তুষ্ট করার লক্ষ্যে কঠোর তপস্যা শুরু করে।
সাধনার প্রথম দশ সহস্র বৎসরে সে প্রানায়াম ও শুধুমাত্র পত্রভক্ষন করে সাধনা করে। দ্বিতীয় দশ সহস্র বৎসরে শুধুমাত্র কয়েক বিন্দু জল ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করেনা। তৃতীয় দশ সহস্র বৎসরে সে বায়ু ভক্ষন করে তপস্যা করে। চতুর্থ সহস্র বৎসরে উপবাস করে সাধনা করে। তখন তার সম্পূর্ণ দেহে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে।
তপস্যাক্লিষ্ট অরুণাসুরের নিকট ব্রহ্মা উপস্থিত হয়ে বর প্রার্থনা করতে বলেন। অসুর অমরত্ব প্রার্থনা করলে ব্রহ্মা রাজী হন না। তখন সে প্রার্থনা করে যে কোন দ্বিপদ বা চতুস্পদ জীবের হাতে তার মৃত্যু হবে না। ব্রহ্মা রাজী হয়ে তাকে সেই বর প্রদান করেন।
এরপর সে সমস্ত অসুরদের নিয়ে স্বর্গরাজ্য আক্রমণ করে। স্বর্গচ্যূত দেবগণ কৈলাস পর্বতে গিয়ে মহাদেবের নিকট পরিত্রানের উপায় প্রার্থনা করে। স্থির হয়, দেবী পার্বতী অরুণাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন এবং ষট্ পদ বিশিষ্ট ভ্রমরেরা তাঁর সৈন্য হিসাবে যাবে। সেই ভ্রমর, মৌমাছি, মশা কুলের আক্রমণে ও দেবীর অস্ত্র প্রহারে অরুণাসুর বধ সম্পূর্ণ হয়। এরপর দেবতারা পুনরায় স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করেন।
অরুণাসুর বধের পর ভ্রমরগুলি পুনরায় দেবীর নিকট ফিরে আসে ও তাঁকে বেষ্টন করে রাখে। তিনিই দেবী মাতা ভ্রামরী কালিকা। সেই রূপেই তিনি পুজিতা হন।
জলপাইগুড়ি শহরের গোশালা মোড় থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে গেলেই চোখে পড়বে ডোমাকৃতির মন্দির। তিস্তানদীর পাশ ধরে এই মায়াবী মন্দির চেনে না বা নাম শোনেনি, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্করই বটে। বৈকুন্ঠপুর জঙ্গলের সারিবদ্ধ শাল ও সেগুন গাছ। চারিদিকে একটা মায়াবী এবং অলৌকিক পরিবেশের মাঝখানে বুক উঁচিয়ে দাড়িয়ে রয়েছে মাতা ভ্রামরীর মন্দির।
মন্দির নিয়ে আরও অনেক গল্প আছে। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে এক লাল কাপড় পরা মহারাজ এসেছিলেন মন্দিরে । তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত বিশাল জটা ছিল। তিনি দীর্ঘদিন মন্দিরে পূজা ও যজ্ঞ করেন। তিনিই তিনটি মোটা গাছের গুড়ির নিচে মায়ের পাথররুপী বাম পার সন্ধান পান । এরপর দেশ বিদেশ থেকে মন্দিরে সাধুসন্তরা আসতে শুরু করে ।
এই এলাকার এক প্রবীণ নিরেন রায় একটি দুর্ঘটনায় নির্দোষ হওয়া সত্বেও মামলায় জড়িয়ে যান। মা ভ্রামরী দেবীর কৃপায় তিনি সেই মামলা থেকে মুক্তি পান । তিনি মার নতুন প্রতিমা তৈরি করে পূজা করে ও জোড়া পাঠা বলি দেন।
সামনে রয়েছে পার্কিং স্পট। সেখান থেকেই শান বাঁধানো পথ চলে গিয়েছে মন্দিরের প্রবেশপথে। দরজার উপরে রয়েছে শিব-পার্বতীর বসে থাকার মূর্তি। মূল মন্দিরের প্রবেশমুখের বাঁদিকে রয়েছে সিদ্ধিদাতা গণেশ। গণেশের আরাধনা করেই মন্দিরে প্রবেশ করেন অনেকে। দেবীমূর্তি দেখে মন ছুঁয়ে যাবে। দেবী অষ্টভূজা, সালংকারা। দেবীর সামনে রাখা বড় বড় পাত্রে রাখা রয়েছে ভক্তদের নিবেদন। মন্দির প্রাঙ্গণেই রয়েছে বিশাল এক দালান। সেখানকার দেওয়ালে দেওয়ালে রয়েছে দেবদেবীর চিত্র। মূল মন্দিরের দরজা দিয়ে এগোলেই দেবীর সামনে রয়েছে ছোট একটি ব্যারিকেড। মহাদেবের মূর্তি রয়েছে দেবীর ডানপাশে, এবং তাঁর পাশে বসে রয়েছেন ষাড়রূপী নন্দী।
কক্ষের বাদিকে রয়েছে সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি নিয়ে যাবে সোজা ভ্রামরীদেবী মন্দিরের গর্ভগৃহে। সেখানেই রাখা রয়েছে সিংহবাহিনী কৃষ্ণবর্ণা দেবীর মূর্তি। পাশে রয়েছে সতীর ৫১ পীঠের অন্যতম সতীর বাম পা। সেই পা রীতিমত রক্তবর্ণ লাল। মহিলাদের নিবেদনের সিঁদুর ও ফুল দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে সেই গর্ভগৃহ। এই পা দেখতে ও পায়ে ফুল দিতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন। মায়াবী এক টান কাজ করে মন্দিরে প্রবেশ করলেই।
মন্দিরের ভেতরে থাকে ঝাঁকে ঝাঁকে পায়রা। এই মন্দির থেকে একটু বেরিয়ে প্রাঙ্গণের ভেতরে ডানেই রয়েছে জোড়াবট। গাছের নীচে রয়েছে লোকনাথ বাবার মূর্তি। খুব অদ্ভুতভাবে জোড়াবটটি নজর কাড়ে। বিশালাকৃতির দুটো গাছ আলাদা আলাদা থাকলেও উপরে উঠে একসঙ্গে মিলে যায়। সেখান থেকেই ছড়িয়ে পড়ে শাখা প্রশাখা। এবং এই শাখার ছায়ার তলেই বিশ্রাম নেন দর্শনার্থীরা। কালীপুজো তো বটেই, শরৎকালে হয় নবরাত্রির পুজো।
মন্দিরটি দিবারাত্রি সর্বদাই খোলা থাকে। এখানে মায়ের নিকট পূজা প্রদানের ক্ষেত্রে পূর্বে নিকটবর্তী তিস্তা নদীতে স্নান করে ধৌত বস্ত্র পরিধান করার রীতি প্রচলিত আছে।এই মন্দিরে পূণ্যার্থীগণের জন্য রাজ্য সরকার কিছু সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এছাড়াও ত্রিস্রোতায় ভ্রামরী দেবীর মন্দিরকে কেন্দ্র করে উত্তরবঙ্গে বৈষ্নব-শাক্ত-শৈব নানা পীঠের পর্যটন সার্কিট গড়েছে রাজ্য সরকার।
মন্দিরে নবরাত্রি ও দুর্গাপূজা সাড়ম্বরে পালিত হয়। মাঘী পূর্নিমার পূণ্য তিথিতে বিশেষ পূজা ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
রেলপথে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে এসে, সেখান থেকে অন্যান্য যানবাহনে মন্দিরে আসা যায়। এছাড়া জলপাইগুড়ি থেকে মায়ের মন্দির মাত্র ১৮ কি মি। তাই সড়ক পথে মে কোনো স্থান থেকে এখানে আসা যায়।
Comment written by Mr Sachi Bilas Ray ----------
ReplyDeleteতথ্যবহুল লেখা। পড়ে খুবই ভালো লাগলো এবং সমৃদ্ধ হলাম।
Comment from Mr Amit Bhattacharya ~~~~~~
ReplyDeleteNicely narrated .... with relevant pics ... Thnq.