বাংলার শিব এক্তেশ্বর**** শৈবতীর্থ এক্তেশ্বর ****
ভক্তি ও আস্থার মেলবন্ধন বাঁকুড়ার ঐতিহ্যবাহী এক্তেশ্বর মহাদেব মন্দির ও তার গাজনে মেলা ও শ্রাবনী মেলা। এই শিবমন্দিরটি আনুমানিক হাজার বছরের পুরোনো। মেঝের মাঝখানে ১২ ধাপ সিঁড়ি নেমে দেখা মেলে বাবা এক্তেশ্বরের। পাথরের মূর্তিটি মানুষ শায়িত শিব ঞ্জানে পূজো করে। আর এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে আয়োজন করা হয় গাজনের আর শ্রাবনী মেলার।
মন্দিরের নির্মাণ বৈচিত্র্য অনন্য। প্রায় ৪৫ ফুট উঁচু ও পশ্চিমমুখী। ল্যাটেরাইট ও বেলেপাথর দিয়ে তৈরি। শিখর বিহীন রেখে দেউল। এ রকম ভারী এবং নিটোল ধরনের মন্দির আর কোথাও দেখা যায় না। পাথরের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এক বিশাল এলাকা নিয়ে এই বিচিত্র মন্দির। ঘেরা চৌহদ্দির মধ্যে রয়েছে কতগুলি উপমূর্তি যেমন লোকেশ্বর বিষ্ণু , ভাঙ্গা বাসুদেব , গনেশ, নন্দী বৃষ আর মনসার। মন্দিরের ভেতর এক যোগীপুরুষ দীর্ঘকাল ধ্যান করেছিলেন। তার আসনটি বিরুপাক্ষের আসন নামে পরিচিত। এই শান্ত, নির্জন পরিবেশে আপনি এলে বিমূঢ় হয়ে যাবেনই।
বাঁকুড়া শহর থেকে ৫ কি মি দূরে রয়েছে এই প্রাচীন এক্তেশ্বর শিব মন্দির। এক কথায় বলা যেতে পারে এটি জেলার সবচেয়ে জনপ্রিয় শিব মন্দির। দ্বারকেশ্বর নদীর ব্রীজ পেরিয়েই ডান দিকের নদীর ধার বরাবর মাটির রাস্তা ধরে খানিকটা এগোলেই পড়বে এক্তেশ্বর গ্রাম। গ্রামের নাম থেকেই সম্ভবত শিবের নাম এক্তেশ্বর।তবে গ্রামের নাম থেকে শিবের নাম করণ হয়েছে, না শিবের নাম থেকে গ্রামের নাম হয়েছে, তা অমীমাংসিতই রয়েছে। তবে শোনা যায় যে এ গ্রামের কোনো এক রাজা উচ্চ নীচ ভেদাভেদ না মেনে সকলকে এক পঙক্তিতে বসিয়ে ভোজন করিয়ে ছিলেন । সেই থেকে এই গ্রামের নাম এক্তেশ্বর।
মন্দিরের গর্ভগৃহ অনেক নীচে। আসামের কামাখ্যা মন্দিরের মতো কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভাঙ্গে নীচে নামতে হয়। কুয়োর মতো জায়গাটা অন্ধকার ও প্রায় সময় জল থাকে। মহাদেব পুব থেকে পশ্চিমে শায়িত। প্রায় ১৪ ইঞ্চি লম্বা। চতুষ্কোন নোড়ার আকৃতি বিশিষ্ট শিবলিঙ্গ। মন্দিরের পাশেই রয়েছে দ্বারেকেশ্বর নদী। এই কুন্ডের সাথে দ্বারেকেশ্বর নদীর এক সংযোগ রয়েছে। ঐ সংযোগ পথ দিয়ে নদীর জল এসে ঐ শিবলিঙ্গকে প্রায়ই নিমজ্জিত রাখে।
ইতিহাসে আমরা সকলেই বিভিন্ন সন্ধির কথা পড়েছি। রাজায় রাজায় যুদ্ধে হেরে গিয়ে বা যুদ্ধ আটকানোর জন্য সন্ধি স্থাপনের রীতি ছিল। কিন্তু বাঁকুড়া শহরের দারকেশ্বর নদ অন্য এক সাক্ষী হয়ে রয়েছে। এই নদের তীরে ভগবান শিবেকে সাক্ষী রেখে ঠিক হয় বিষ্ঞুপুর ও কাশীপুর রাজার রাজ্যের সীমানা। দুই ভূমের একতা রাখার সাক্ষী ছিলেন স্বয়ঙ মহাদেব। বিবাদমান দুই রাজ্যের এক্তিয়ারের অভিভাবক ও ঈশ্বর হলেন এই শিব। তাই ইনি এক্তেশ্বর শিব বলে পরিচিত।
ইতিহাসের চালিকাশক্তি হল লোকশ্রুতি। এখানেও দুই রাজার সন্ধি স্থাপনের ইতিহাস লোকশ্রুতি নির্ভর এবং সেটি এই রকম ............. রাজ্যের পশ্চিম সীমানা বরাবর চলছিল সিন্দুক বোঝাই সারি সারি গরু গাড়ি । রাজার আদেশ লুন্ঠিত হল সেসব সিন্দুক । সিন্দুক খুলেই অবাক হলেন মল্লরাজ । এতে তো সারি সারি পুঁথি ! কোথায় সাত রাজার ধন? ভ্রম ভাঙালেন চৈতন্য দেবের প্রিয় পাত্র শ্রীনিবাস আচার্য্। চৈতন্য দেব আর ফিরবেন না নবদ্বীপ ধামে, মনস্থির করেছেন পুরীতে রয়ে যাবেন তিনি । তাই তাঁর আগ্রহে সমগ্র পুঁথি চলেছিল পুরীতে । কিন্তু মাঝপথে তা লুন্ঠন করেছেন মল্লরাজ । এই পুঁথিতে কী এমন সাত রাজার ধন আছে বুঝে উঠলেন না মল্লরাজ । এরপরই পুঁথি পড়ে শোনালেন শ্রীনিবাস আচার্য্ । সারা সভাগৃহ মাতোয়ারা হলো কৃষ্ণ প্রেমে । ধন্য ধন্য করে উঠলেন মল্লরাজ । বুঝলেন এই পুঁথিতে কী অমূল্য ধন আছে । শাক্ত মল্লরাজ নিলেন বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা, বিষ্ণুপুরে প্রতিষ্ঠা হল রাসমঞ্চ ।কিন্তু এ সময়েই হঠাৎ করে সামন্তভূম (ছাতনা) ত্যাগ করে মল্লরাজ রঘনুাথ মল্লের আশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা গ্রহণ করেন বড়ুচন্ডীদাস যিনি কিনা সামন্তভূম রাজ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মা বাসুলীর প্রধান পুরোহিত। প্রধান পুরোহিত অন্য রাজ্যে আশ্রয় নেওয়াতে গোটা সামন্তভূম ক্ষোভে ফুঁসতে লাগলো। এই ক্ষোভ ছাড়িয়ে যায় বৃহৎ মল্লভূমের সীমানা পর্যন্ত। যার ফলস্বরূপ দুই রাজ্যের সীমা নিয়ে বিরোধ বাধে, সৃষ্টি হয় এক ভয়ংকর অবস্থা । এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে উদ্যোগী হয় দুই রাজপরিবারই । দারিকেশী নদী বা বর্তমানের দ্বারকেশ্বর নদের তীরে ভগবান শিবকে সাক্ষী রেখে নির্দেশিত হয় দুই ভূমের সীমানা । দুই ভূমের একতা রক্ষার সাক্ষী ছিলেন ঈশ্বর । সেই থেকে জায়গার নাম পড়ে 'এক্তেশ্বর' এবং বিরোধের নিস্পত্তি ঘটে এই 'এক্তেশ্বর' সন্ধির মধ্য দিয়ে। দুই সীমানার সংযোগ স্থলে একতার প্রতীক হিসেব মল্লরাজা রঘুনাথ মল্ল গড়ে তোলেন এই এক্তেশ্বর শিব মন্দির এবং প্রবর্তন করেন এক্তেশ্বরের গাজনের ।
অনেকের মত আবার এই রকম ____ বেদে এক পদেশ্বরের উল্লেখ আছে যে নামটি অপভ্রংশ এক্তেশ্বরে এসে দাঁড়িয়েছে । এক্তেশ্বর মন্দিরে শিব একপদ মূর্তি নামে পূজিত হন । এই ধরনের শিবের মূর্তি অন্য কোথাও দেখা যায় না বলে এটি অত্যন্ত বিরল ।
আবার এও শোনা যায় ----- প্রাচীনকালে এই অঞ্চলে যে জনগোষ্ঠী বাস করতো তাঁরা নিজেদের সূর্যের সন্তান বলে প্রচার করতেন। এই আদিবাসীরা ছিলেন একেশ্বরবাদী। তাই অনেকে মনে করেন এক ঈশ্বর থেকে এক্তেশ্বর নামটি সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয়দের মতে এক সময় এক্তেশ্বর শিবমন্দিরে কাঁটা ঝাঁপ, চড়ক গাছ, বাণফোড়াসহ বিভিন্ন ভয়ঙ্কর প্রথা পালন করা হতো। শিবের খেউর নামক এক অদ্ভুত প্রথা পালন করা হত যেখানে সন্ন্যাসীরা গালীগালাজ করতেন একে অপরকে। বর্তমানে এ সব প্রথাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার মতো ভয়াবহ প্রথাও। গাজনের প্রায় ১৫ দিন আগে শিবের ভক্তরা জড়ো শুরু করেন এই অঞ্চলে। সন্ন্যাসীদের " হর হর ব্যোম ব্যোম " ধ্বনিতে কেঁপে উঠে সারা মন্দির চত্বর। শিব আরাধনার গর্জনে মুখরিত হয়ে ওঠে এক্তেশর গাজন মেলা।
মন্দিরের কুন্ডের মধ্যে যে শিব লিঙ্গটি রয়েছে সেটি নাকি কিছুটা বাঁকা ভাবে অবস্থান করছেন। অনেকে মনে করেন এই কিঞ্চিত বাঁকা শিবলিঙ্গ থেকেই বাঁকুড়া নামের উৎপত্তি। শুধু বাঁকুড়া বা বাংলা নয়, সারা বিশ্বের শিব ভক্তদের কাছে এটি একটি প্রসিদ্ধ তীর্থক্ষেত্র। আজও ফাল্গুন মাসে, শিব চতুর্দশী তিথিতে, শিবরাত্রি উৎসবে কয়েক হাজার দর্শনার্থীর সমাগম হয়। শ্রাবনী মেলাকে ঘিরে সকলের এক আলাদা উন্মাদনা থাকে। দেবাদিদেব মহাদেবের মাথায় জল ঢালতে দূরদূরান্ত থেকে মন্দিরে আসেন ভক্তরা। শ্রাবন মাসের সোমবার গুলিতে মন্দির চত্বরে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। শ্রাবন মাস, শিবরাত্রি , চৈত্র সংক্রান্তিতে সব মিলিয়ে লাখ লাখ ভক্তের সমাগম হয় এই মন্দিরে।
Comment of Smt Tinku Deb Basu
ReplyDeleteKhub sundor lekhata
শ্রীমতি সন্ধ্যা বোসের মন্তব্য এই রকম :
ReplyDeleteঅসাধারণ লাগলো পড়ে।আমাদের বাড়ী বাঁকুড়া তে মা ও ঠাকুমার কাছে এই মন্দিরের নাম অনেক বার শুনেছি তবে বিস্তারিত ব্যাখ্যা পেয়ে আরো সমৃদ্ধ হলাম।
Comment of Mr Amit Bhattacharjya
ReplyDeleteBah darun lekha o chhobi
শ্রী কল্লোল বসুর মন্তব্য এই রকম ::
ReplyDeleteএক কথায় অসাধারন