Sunday, 17 September 2023

জলমগ্ন মঙ্গলের প্রতিক--- জল্পেশ্বর শিব

 


ময়নাগুড়ির জল্পেশ মন্দিরে জল্পেশ্বর শিব 

উত্তরবঙ্গের নামী শিবমন্দিরগুলির অন্যতম জল্পেশ।  ভগবান শিবের প্রাচীন মন্দির।  এই মন্দিরের প্রধান দেবতা  "জল্পেশ্বর" অর্থাৎ ভগবান শিবের একটি রুপ। এই ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যমন্ভিত মন্দিরটি জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি থেকে আট কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।  পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে জরদা নদী। এখানে শিবলিঙ্গ হল জল লিঙ্গ।  অর্থাৎ শিবলিঙ্গ এখানে গর্তের মধ্যে জলের ভিতর থাকেন যাকে বলা হয় জল লিঙ্গ  বা অনাদি। গর্তে জল ঢেলে পূন্য অর্জন করতে হয়। কথিত আছে এই মন্দির ভ্রামরী শক্তিপীঠের সঙ্গে জড়িত। জলেশ্বর হলেন দেবী ভ্রামরীর ভৈরব। মন্দিরটি মনোরম স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত। পুরাণ অনুযায়ী , এই মন্দির হাজার বছরেরও বেশী পূরানো। অনেকেই বলেন , দিল্লির মুসলমান স্থপতিরা এই মন্দির তৈরি করেন বলে মন্দিরের চূড়া গম্বুজাকৃতি। মন্দিরটি ১২৪ ফুট দীর্ঘ,  ১২০ ফুট চওড়া আর উচ্চতা ১২৭ ফুট। মন্দিরে নারায়ণ,  কালী, কুবেশ্বর এবং ভ্রামরী দেবীর মূর্তিও  আছে। মন্দির কমিটি ভক্তদের কাছ থেকে কুড়ি টাকা ( সাধারণ) থেকে একশো টাকা ( স্পেশাল ) টিকিট বাবদ নিয়ে থাকেন।  তা দিয়ে মন্দিরের বিভিন্ন সময়ে নানা সংস্কার হয়ে থাকে। এই মন্দিরে ৭ জন পুরোহিত  ও ৩০ জন কর্মচারী আছেন। প্রতি মাসে কয়েক লক্ষ টাকা খরচ হয় তাদের বেতন বাবদ। ট্রাষ্টি বোর্ডের কর্মকর্তা জানালেন মন্দিরের এসব খরচের টাকা বেশিরভাগ মেলার সময় রোজগার হয়। এছাড়া  বহু লোক প্রচুর দান করেন। আর টিকিট বিক্রির  টাকা দিয়ে মন্দির রক্ষণাবেক্ষণ চলে।  মহাশিবরাত্রিতে ও শ্রাবন মাসে লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থীর ভিড় হয়।  অনেকেই মানত করে তিস্তা থেকে হেঁটে হেঁটে কাধে বাক নিয়ে মন্দিরে পৌচ্ছায়। শিবলিঙ্গে জল নিবেদনের ঐতিহ্য একটি প্রাচীন রীতি যা আজও অগাধ ভক্তি ও বিশ্বাসের সাথে অনুসরণ করা হয়।



জল্পেশ মন্দির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বৃহত্তম শৈব তীর্থ। এই শৈবক্ষেত্রে জনপ্লাবন দেখতে হলে আপনাকে আসতে হবে শিবরাত্রির সময় বা শ্রাবন মাসে। লোকপুরান বা লোকবিশ্বাসকে যদি আপনি আলোচনা করেন তবে দেখা যায় যে প্রাচীন সিল্ক রুট বা রেশম পথের উপর গড়ে উঠেছিল এই জল্পেশ মন্দির।  আদি নাম গড়তলি। জল্পেশের উল্লেখ আছে কালিকাপুরান বা স্কন্দপুরানে। প্রচলিত বিশ্বাস , প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা জল্প অথবা জল্পেশ এখানে মন্দির তৈরি করেন। তার নামেই নামকরন হয় এই মন্দিরের।  তবে এই বিশ্বাসের কোনো প্রমাণ নেই। আবার পুরোনো গল্প কাহিনী থেকে জানা যায়, স্বামীর মৃত্যুর পর অসমের রানী ময়নামতি  জল্পেশের কর্পূর জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলেন।  সেখানে সাধু ছদ্মবেশে সেনাপতি হানা দিলে যুদ্ধ হয়। সেনাপতি মারা যান।  পরবর্তীতে তিনি ধোওলা ঠাকুর নামে দেবায়িত হন। মন্দিরের পাশে সেই থান  রয়েছে। তবে এই বিশ্বাসেরও ঐতিহাসিক তথ্য তেমন মেলে না। 


ইতিহাস ঘাটাঘাটি করলে দেখা যায় যে  শ্রী বিশ্ব সিংহ ১৫২৪ সালে জল্পেশ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ইনি ছিলেন কোচবিহার মহারাজা নরনারায়নের পিতা। পরবর্তীকালে ১৫৬৩ সালে মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেন।  আবার ১০০ বছর পরে রাজা প্রান নারায়ণ ১৬৬৩ সালে মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেন। এরপর কোচবিহারের রাজা লক্ষী নারায়ণের রাজত্ব কালে কোচ রাজবংশের বশ্যতা অস্বীকার করার পর, মহাদেব রায়কত তার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং কোচ রাজাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে অস্বীকার করেন।  এরপর থেকে মন্দিরটি বৈকুন্ঠপুরের রায়কতদের তত্ত্বাবধানে ছিল।  ১৮৯৯ সালের ৩০ শে জানুয়ারি রাজা গজেন্দ্র দেব রায়কতের স্ত্রী রানী জগদেশ্বরী দেবী এর  পুনপ্রতিষ্ঠা করেন। "মহাশিবরাত্রী" এই মন্দিরটির উদযাপনের প্রধান উৎশব। এছাড়া শিবের কাছে বিশেষ পূজা করার জন্য আগষ্ট মাসে শ্রাবনী মেলায় প্রচুর তীর্থযাত্রীর সমাগম হয়ে থাকে। 





সপ্তদশ শতকে মন্দির তৈরির পর থেকেই এখানে শিবরাত্রিতে বিখ্যাত মেলার সূচনা। সেই দিক থেকে মেলাটি গোটা রাজ্যেরই প্রাচীন মেলাগুলির অন্যতম। ডুয়ার্স যখন ভুটানের অংশ ছিল, তখন ময়নাগুরিকে কেন্দ্র করেই পাহাড় ও সমতলের ব্যবসা হত। ফলে এই মেলার বানিজ্যিক গুরুত্ব ছিল  অসীম। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা হওয়ার আগে এখানে হাতি বিক্রি হত।  নেপাল, ভূটান, বাংলাদেশ ও অন্যান্য নিকটবর্তী রাজ্যের লোকেরা এখানে মেলায় আসে। 



শিব উপাসকদের কাছে এই মহাশিবরাত্রি এক বিশেষ দিন। শিব ও শক্তির মহামিলনকে কেন্দ্র করেই উদযাপনের হয় শিবরাত্রি। মন্দিরের ভিতরে " ওঁম শিবায় নম: " ধ্বনিতে মেতে থাকে চার প্রহর। স্থানীয় লোকজন এই উদযাপনকে শুভ ও সমৃদ্ধির বাহক বলে বিশ্বাস করে। এক মাস ব্যাপী এই মেলায় যে রেকর্ড ভীর হয়, তা চরম জনপ্রিয়তাকেই প্রমান করে। শুধু স্থানীয় লোকজনই নয়, ভারতের দূরদূরান্তের মানুষও এই মেলায় অংশ নিতে আসে। এই মেলার উপর প্রচুর মানুষের রুটি রোজগার নির্ভর করে। দেখাযায় বছরের প্রায় ছয় মাসের রোজগার এই মেলা থেকে হয়ে থাকে। তবে শিবরাত্রির পাশাপাশি শ্রাবন মাসেও এখানে ভিড় করেন ভক্তের দল। স্থানীয় লোকেরা এই মেলাকে শ্রাবনী মেলা হিসেবেই চেনে। সেই সময় " হর হর মহাদেব " ধ্বনিতে মুখরিত হয় মন্দির ও মেলা চত্বর।  দুটি মেলাই বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষকে তাদের জাতি, ধর্ম এবং সংস্কৃতি নির্বিশেষে একত্রিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়।




6 comments:

  1. শ্রী সচীবিলাশ রায় মন্তব্য করেছেন ::

    তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। খুবই ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  2. Mrs Kajal Roy has mentioned ----

    Ami 2 bar gechhi kintu eto kichhu jantam na ekhon pore janlam r valo laglo

    ReplyDelete
  3. শ্রী মতী রুপালী রায় $$

    🙏🙏🙏

    ReplyDelete
  4. শ্রী মতী সন্ধ্যা বোস বলেছেন _____

    জল্পেস্বর শিব মন্দিরের বিষয় অনেক বিস্তারিত তথ্য জানতে পেরে ভাল লাগল। 🙏🙏

    ReplyDelete
  5. শ্রী রনেন চক্রবর্তী তার মন্তব্য এই ভাবে প্রকাশ করেছেন*******

    Opurbo, khub bhalo laglo.

    ReplyDelete
  6. শ্রী অমিত চক্রবর্তী (জয়) বলেছেন --:--

    Darun

    ReplyDelete