Sunday, 11 August 2019

কাছে পিঠে ** পায়ে পায়ে** কুলীন গ্রাম









কুলীন গ্রাম -- শ্রীচৈতন্যের পদধূলিধন্য














শ্রীচৈতন্যদেবের পদধূলি ধন্য এই কুলীন গ্রাম। রাজা বল্লাল সেন আনুমানিক ১৪৮০ খৃষ্টাব্দে  কান্যকুব্জ থেকে উনিশ জন ব্রাহ্মন ও তিনজন কায়স্থ পরিবারকে এনে এই গ্রামে বসিয়ে ছিলেন এবং তাদেরকে কৌলীন্য মর্যাদা দিয়েছিলেন। কৌলিন্য মর্যাদা পেতে গেলে নয়টি গুন আবশ্যিক ছিল। যেমন ---- সামাজিক উন্নত ব্যবহার বা আচার, বিনয়, বিদ্যা, সমাজে প্রতিষ্ঠা বা সন্মান, তীর্থ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, কার্যে নিষ্ঠা, স্বাধীন ও সৎবৃতি, দেবার্চনা ও দানশীলতা। জনশ্রুতি আছে যে বর্ধমান জেলার যে গ্রাম থেকে উনিশ জনের মধ্যে চারজন এই কৌলীন্য মর্যাদা লাভ করেন সেই গ্রাম হল কুলীন গ্রাম।




‘কায়স্থ কুলেতে জন্ম কুলীনগ্রামে বাস’-ভনিতায় ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’-এর কবি মালাধর বসু তাঁর নিবাসের উল্লেখ করেছেন৷ কুলীনগ্রামে  মালাধরবসু জন্মগ্রহণ করেছিলেন পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগেই৷ শ্রীমদ্ভাগবত ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অবলম্বনে তাঁর শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের রচনাকাল ১৪৭৩ -৮০ খ্রিস্টাব্দ৷ অর্থাত্ শ্রীচৈতন্যের (১৪৮৬ -১৫৩৩ ) আবির্ভাবের আগেই রচিত হয়েছিল এই কাব্য৷ মালাধর বসুর পৌত্র রামানন্দ বসু (পিতা লক্ষ্মীনাথ বসু বা সত্যরাজ খান ) ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তরঙ্গ পার্ষদ৷ বসু পরিবারের আমন্ত্রণেই শ্রীচৈতন্যদেব কুলীনগ্রামে আসেন এবং তিন দিন অবস্থান করেন৷ এই ঘটনার সমর্থন ‘চৈতন্যমঙ্গল ’-এ আছে৷ রামানন্দ বসুর শ্রীপাট রূপে পরিচিত কুলীনগ্রাম বৈষ্ণবতীর্থস্থান হিসেবে দেশজোড়া খ্যাতি লাভ করে।
চৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবের পূর্বেই বাঙলাদেশের বৈষ্ণবীয় ভাবধারা প্রসারে মালাধরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আর বৈষ্ণবীয় ভাবধারাতে কুলীন গ্রামের প্রতিপত্তিও ছিল যথেষ্ট। কুলীন গ্রামের হরি সংঙকীর্তনের দল নীলাচলে গিয়ে মহাপ্রভুর সঙ্গে কীর্তনে যোগ দিতেন
" কুলীন গ্রামের এক কীর্তনীয় সমাজ।
   তাহে নৃত্য করে রামানন্দ সত্যরাজ ।।"
কুলীন গ্রামের পট্টডোরী দিয়ে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার শেষ অধিষ্ঠান সম্পন্ন হয়। এটিও সম্ভব হয়েছিল মহাপ্রভুর আদেশানুসারে ----------
"কুলীন গ্রামী রামানন্দ সত্যরাজ খান।
তাঁরে আঞ্জা দিল প্রভু করিও সন্মান।।
এই পট্টডোরীর তুমি হও যজমান।
প্রতি বর্ষ আনিবে ডোরি করিও নির্মাণ।।"

অর্থাৎ মালাধর বসু ও কুলীন গ্রাম চৈতন্য দেবের সমকালেই সুপরিচিত ও শ্রদ্ধেয় হয়ে উঠেছিলেন
বসু পরিবারের কৃষ্ণভক্তিতে প্রীত হয়ে শ্রীচৈতন্যদেব প্রতি বছর পুরীতে স্নানযাত্রায় কুলীনগ্রাম থেকে পট্টডোরি পাঠানোর দায়িত্ব দেন৷ পট্টডোরি হল তুলোর উপর নানা রঙের রেশম সুতো দিয়ে পাকানো কাছি বা বন্ধনী৷ এই কাছি দিয়েই জগন্নাথ , বলরাম , সুভদ্রাকে রথের সঙ্গে বাঁধা হত এবং গলায় মালার মতো পরানো হত৷ পরবর্তীকালে এই পট্টডোরি সরবরাহে ছেদ পড়ে৷

কুলীনগ্রামে বহু প্রাচীন দেবদেবীর মূর্তি এবং মন্দির আছে৷ জগন্নাথদেব তাঁদের মধ্যে অন্যতম৷ কথিত আছে , লক্ষ্মীনাথ বসু প্রতিষ্ঠা করেন জগন্নাথ মূর্তির৷ স্থানীয় প্রবীণ শিক্ষক শচীনন্দন মুখোপাধ্যায়ের মতে , জগন্নাথ বিগ্রহ পাঁচশো বছরেরও বেশি পুরনো হলেও রথযাত্রার প্রচলন হয় অনেক পরে৷ কুলীনগ্রামের রথযাত্রা উত্সবের প্রচলন হয় অনধিক দু’শো বছর আগে৷ জগন্নাথ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার পরবর্তী তিনশো বছর কেন রথযাত্রা হয়নি , সে প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন তিনি৷ তাঁর মতে , ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি আক্রমণের সময় থেকে হিন্দুদের ধর্মীয় জীবনে প্রচণ্ড আঘাত নেমে আসে৷ প্রকাশ্যে ধর্মীয় আচার প্রায় বন্ধই হয়ে যায়৷ পাঠান আমলে শাহী বংশের রাজত্বকালের শেষভাগে চৈতন্যদেবের আবির্ভাব ও বৈষ্ণবধর্ম আন্দোলন বাংলায় হিন্দুদের ধর্মীয় জীবনে কিছুটা আশার সঞ্চার করে৷ কিন্ত্ত ১৬২৫ খ্রিস্টাব্দে মোগল আক্রমণের ফলে আবার আশঙ্কার মেঘ সঞ্চারিত হয়৷ ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধের পর বাংলা তথা ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে পরিবর্তন শুরু হয়৷ ব্রিটিশ শাসনে সামাজিক , রাজনৈতিক ও ধর্মীয় -সর্বস্তরেই অবদমিত হিন্দুদের ধর্মীয় কার্যকলাপের স্ফুরণ ঘটে।

কুলীনগ্রাম বর্ধমান জেলার জামালপুর ব্লকের আবুজহাটি -২ গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত৷ বর্ধমান -হাওড়া কর্ড লাইনে জৌগ্রাম স্টেশনে নেমে ই -রিক্স বা ট্রেকারে চেপে যেতে হয় কুলীনগ্রামে৷ জৌগ্রাম স্টেশন থেকে দূরত্ব মোটামুটি ৬ কিলোমিটার৷

কুলীনগ্রামের জগন্নাথের পুরনো মন্দিরটি কালের অতলে হারিয়ে গেছে৷ মন্দিরের প্রবেশদ্বারটি প্রাচীন ঐতিহ্যকে জানান দিতে এখনও টিকে আছে মাথায় বটগাছের বোঝা নিয়ে৷ পুরনো মন্দিরের বিগ্রহগুলিকে স্থাপন করা হয় বহু পরে নির্মিত দালান মন্দিরে৷ সেটির পরে সংস্কার করা হয়৷ এই মন্দিরেই স্থাপন করা হয়েছে পুরনো মন্দিরে থাকা প্রাচীন গড়ুর এবং বিষ্ণু মূর্তিকে৷

কুলীনগ্রামের জগন্নাথ -বলরাম -সুভদ্রা নিমকাঠের তৈরি৷ স্নানী পূর্ণিমায় স্নানযাত্রা হয় মন্দিরের সামনের নির্দিষ্ট বেদীতে৷ স্নানযাত্রার পর নতুন করে জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রার নবরাগ অর্থাত্ নতুন রং করা হয়৷ রথযাত্রার দু’দিন আগের অমাবস্যায় নতুন বস্ত্র পরিয়ে সিংহাসনে তোলা হয়৷ শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়ায় রথযাত্রার দিন দুপুরে বিগ্রহের জন্য অন্নভোগ দেওয়া হয় পুরোনো রীতি মেনে৷ পঞ্চব্যঞ্জন -সহ জগন্নাথদেবকে দেওয়া হয় খিচুড়িভোগ , বলরামের জন্য সাদা অন্নভোগ , সুভদ্রার জন্য পায়েস৷ বিকেল চারটে নাগাদ বিগ্রহদের মন্দিরের সিংহাসন থেকে রথে তোলার জন্য নিয়ে আসা হয়৷ রথকে সাত বার পরিক্রমা করে তাঁদের রথে তোলা হয়৷ বিগ্রহগুলিকে আগে রেশমের তৈরি পট্টডোরি দিয়ে বাঁধার রীতি চালু ছিল৷ এখন পট্টডোরি সাধারণ সুতোর তৈরি৷ তার পর সেখানে বিগ্রহদের ভোগ দেওয়া হয়৷ এটিকে দাঁড়ভোগ বলা হয়৷ ভোগ দেওয়ার পর সেবাইত পরিবারের প্রবীণ সদস্য রথের ওপর বসেন৷ তিনি বিগ্রহের কলেবর স্পর্শ করে থাকেন৷  এর পর রথের রশিতে টান পড়ে৷ রথ চলে যায় গোপেশ্বর শিবমন্দির সংলগ্ন ষষ্ঠী বটতলায়৷ সেখানেই রথের মেলা বসে৷ রথ থেকে উলটো রথ পর্যন্ত মেলা বসে৷ সন্ধ্যা ছ’টার পর আবার রথকে ফিরিয়ে আনা হয় রথের ঘরে এবং বিগ্রহদের নামানো হয়৷ ভক্তরা বিগ্রহদের স্পর্শ করেন বা কোলে নেন পুণ্যলাভ বা মনস্কাম পূরণের আশায়৷ এর পর বিগ্রহদের আনা হয় জগন্নাথ মন্দিরের উল্টোদিকে পুকুরের অন্য পারে রঘুনাথ বাড়ি বা মাসির বাড়িতে৷ রঘুনাথজিউ মন্দিরে অধিষ্ঠিত আছেন রাম -সীতা -লক্ষ্মণ -হনুমান৷ এ ছাড়াও আছে কালো পাথরের শিবলিঙ্গ৷ এখানেই উল্টোরথ পর্যন্ত অবস্থান করেন জগন্নাথ -সুভদ্রা -বলরাম৷ তাঁদের অবস্থানকালে এই মন্দিরে বিশেষ পুজো ও ভোগের ব্যবস্থা করা হয়৷

বর্তমানে বসু পরিবারের কোনও সদস্যই কুলীনগ্রামে থাকেন না৷ রথের মেলার দায়িত্ব স্থানীয় গাঙ্গুলী পরিবারের৷ বর্তমান সেবাইত অশীতিপর বিজয়ারানি গাঙ্গুলী৷ এখন যে রথটি টানা হয় সেটি তিন নম্বর রথ৷ ত্রিশ ফুট উঁচু রথটিকে সারা বছর রোদ -জলের হাত থেকে বাঁচাতে ছাদ দেওয়া ঘর নির্মাণ করা হয়েছে৷ এই রথটি তৈরি হয় প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে৷ উপযুক্ত পরিচর্যার ব্যবস্থা থাকায় রথটিকে প্রায় নতুন মনে হয়৷

চার -পাঁচ বছর অন্তর রথের রশি পরিবর্তন করা হয়৷ এত দিন পর্যন্ত নারকেলের তৈরি রশি চালু থাকলেও এখন নাইলনের রশির সাহায্যে রথ টানা হয়৷ রথতলায় পুরনো রথের রশি কেটে বিক্রির একটা রীতি চালু আছে৷ লোকবিশ্বাস এই যে এই রশি পবিত্র এবং বাড়িতে রাখলে সংসারের মঙ্গল হয় , এমনকী ছারপোকার উপদ্রব থেকে মুক্তি পাওয়া যায়৷

গ্রামের একদম শেষ প্রান্তে নির্জন স্থানে রয়েছে হরিদাস ঠাকুরের শ্রীপাট। এখানে মহাপ্রভুর সমসাময়িক কালের বেদ অধ্যাপনাকারী ব্রাহ্মণ জগদানন্দ পাঠকের বাড়ি ছিল। মহাপ্রভু নীলাচল যাত্রার পর ফুনলিয়া ত্যাগ করে শ্রীহরিদাস ঠাকুর বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করেন। বর্তমানে এটি গৌড়ীয় মিশন পরিচালনা করেন। প্রতিদিন অন্ন ভোগ হয়। আগে থেকে ফোন করে জানালে অন্ন প্রাসাদ পাওয়া যায়। ফোন নম্বর :: ৭৬০২৫৪৬১৪৬ ও ৮৯২৬৩৮৬৮৫৮
প্রতি বছর আশ্বিন মাসে হরিদাস ঠাকুরের তিরোধান উৎসব ও অগ্রহায়ণ মাসে পূর্ণিমায় মঠের বার্ষিক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
বাংলার মানুষ ভ্রমনের কারনে কত দূর দূর ঘুরে বেড়ান। নিজেদের রাজ্যে সমৃদ্ধ ইতিহাস, মন্দির, উৎসব, মেলা দেখেও দেখেন না, শিকরের টান উপলব্ধি করাটা একটা মস্ত ভ্রমন, দরকার একটু সচেতনতার। ভ্রমনকারীরা যখন এই সমৃদ্ধ স্থানগুলিকে উপলব্ধি করতে পারবে তখন ভ্রামনিকের আনাগোনায় ইতিহাস আরও জীবন্ত হয়ে উঠবে ‌

কুলীনগ্রামের রথ প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতীক৷ যে কোনও ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে গেলে তার পরিচর্যা ও সংস্কার দরকার৷ এর জন্য অর্থের প্রয়োজন৷ সেবাইত পরিবারের পক্ষ থেকে বারবার করে অর্থাভাবের কথা জানানো হচ্ছে।  মেলার দোকান বা ভক্তদের থেকে যে অর্থ পাওয়া যায় , তা কুলীনগ্রামের এই প্রাচীন ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে যথেষ্ট নয়৷ সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা অর্থসাহায্যে এগিয়ে না এলে ইতিহাসখ্যাত কুলীনগ্রামের রথের মেলা শেষ হয়ে যাওয়ার নতুন ইতিহাস রচিত হবে৷
জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি
কুলীন গ্রামের রথ


দূরে দেখা যায় রঘুনাথ মন্দির


মা শিবানীর ইটের তৈরি পাকা মন্দির

কুলীন গ্রাম



শ্রী হরিদাস ঠাকুরের মঠ


মঠের পাশে সাধুদের সমাধিস্থল।

মঠের পাশেই সেই সাধনা ক্ষেত্র।

মঠের ভিতরে ঠাকুর
বিশাল গোপাল দিঘি

কুলীন গ্রামের প্রাচীন গোপাল মন্দির

শ্রীকৃষ্ণের ডানপাশে শ্রীরাধিকা ও বাঁপাশে ললিতা সখী


গোপেশ্বর শিবমন্দির


গ্রামের মধ্যে বড় বড় দীঘি





উপবেশনরত অবস্থায় গরুড় মূর্তি

কষ্টিপাথরের বৃষমুর্তি ( নন্দীমুর্তি )







কুলীন গ্রামের চাষের জমি

হরিদাস ঠাকুরের পাট বাড়ীর প্রবেশ পথ।

হাটতলায় প্রাচীন বিরাট বট গাছ।



No comments:

Post a Comment