Saturday, 13 February 2021

চিল্কিগড়ের মা কনক দুর্গা, ঝাড়গ্রাম

 

চিল্কিগড়ের মা কনক দুর্গা।




পশ্চিম মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রাম। ঝাড় ও গ্রাম .... এই দুই শব্দের মেলবন্ধনে সৃষ্টি ঝাড়গ্রাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এই ঝাড়গ্রাম শহর থেকে জামবনি যাবার রাস্তায় প্রায় ১৬ কি মি দূরে ডুলুঙ নদী। নদীর পূর্ব তীরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে গাছ গাছালিতে ঘেরা এক মনোরম স্থানে কনক দুর্গা মন্দির। আর পশ্চিম তীরে রয়েছে চিল্কিগড় রাজবাড়ী। শহুরে কোলাহল থেকে বহু দূরে এই মন্দিরের অবস্থান। দেবী এখানে অশ্বারোহিনী চতুর্ভূজা।



শোনা যায়, কনক দুর্গা আদিতে ‌ মন্ডিত ছিলেন না। তিনি ছিলেন বনের মধ্যে গাছের নিচে বনদুর্গা বা বনচন্ডী। ঘোড়া তার বাহন , হাতি তাঁর সাথি। বনবাসী মানুষের বিপদে আপদে তিনি ছিলেন তাদের পরিত্রাতা। ইতিহাস ঘাটলে জানা যায়, আনুমানিক ১৭৪৯ সালে জামবনির রাজা গোপীনাথ সিংহ বনের মধ্যে মত্তগজ বনদুর্গার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে জগদীশ চন্দ্র ধবলদেব বনদুর্গাকে কনকদুর্গায় পরিনত করেন এবং নতুন মন্দির নির্মাণ করে দেন। কথিত আছে ধলভূমগড় রাজবংশের সঙ্গে একবার জামবনি রাজবংশ শরিকী মামলায় জড়িয়ে পরেছিলেন। তখন জামবনির রাজা জগদীশ চন্দ্র ধবলদেব বনদুর্গার কাছে গিয়ে মানত করেন যে, দেবীর কৃপায় যদি তিনি মামলায় জিততে পারেন, তাহলে তিনি বনদুর্গাকে কনকমন্ডিত করে নতুন মন্দিরে স্থাপন করবেন। জাগ্রত বনদেবীর মাহত্যে তিনি মামলায় জয়লাভ করলেন। রাজার যেমন কথা তেমন কাজ। এমন সময়ে দেবী নাকি স্বপ্নে রাজাকে চতুর্ভূজা মূর্তি নির্মাণের আদেশ দেন। রানি নিজের হাতের কঙ্কন খুলে দিলেন মায়ের স্বর্নমূর্তি গড়ার জন্য। রাজা সেইমত রানির হাতের সোনার কঙ্কন দিয়ে কনক দুর্গার মূর্তি গড়িয়ে নতুন মন্দির নির্মান করে তাতে দেবীকে স্থাপন করেছিলেন। দেবী এখানে চতুর্ভুজা এবং অশ্ববাহিনী। ঊরিষ্যার শতপথী ব্রহ্মণরা এই দেবীর পুরোহিত। 




বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে সোনার তৈরি কনকদুর্গার আদি মূর্তি চুরি হয়ে গেলে নতুন অষ্টধাতুর মূর্তি তৈরি করে স্থাপন করা হয়। সেটিও চুরি হয়ে গেলে ২০১১ সালে বর্তমানের পিতলের দেবী মূর্তি তৈরি করা হয়েছে। কনকদুর্গার প্রাচীন পূর্ব মুখী মন্দিরটি ধ্বঙশের কবলে পড়ায় সেটির সঙস্কার না করে ১৯৩৭ সালে প্রায় ৫০ ফুট উঁচু দখিনমুখি একটি মন্দির নির্মান করা হয়েছে। নূতন মন্দিরের গঠন উড়িষ্যার রেখ দেউলের মতন। প্রাচীন মন্দিরের সাথে নূতন মন্দিরের কোনো মিল নেই।





ঝাড়গ্রামের চিল্কিগড় এই বনাঞ্চলে অর্জুন, নিম, বাবলা, বকুল, কদম, পলাশ, কনকচাঁপা, কুচিলার মত গাছ আর তাদের গায়ে পেঁচানো কাঞ্চন, রক্তপিতা, আতাড়ি প্রভৃতি কাষ্ঠল লতার সমারোহে গঠিত হয়েছে এক সঙরখিত পবিত্র অরন্য। কনকদুর্গা মন্দির সঙলগ্ন প্রায় ৬৮ একর বনভূমি সম্পূর্ণ ঔষধি গাছ দিয়ে ঘেরা। তাই সমগ্র ভারতের উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা ঔষধ গবেষণার কাজে এই বনভূমিতে আসেন। এই মন্দিরের একটু দূরেই বহুপ্রাচীন নাক্সভোম গাছের সন্ধান পাওয়া যায়। পূর্বে রাজা গোপীনাথ এর পরবর্তী উত্তরসূরীরা আয়ুর্বেদিক স্বাস্থ্য চর্চায় বিশেষভাবে পারদর্শী ছিলেন। তাই এই রাজারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে এমনকি বিদেশ থেকে ঔষধি বৃক্ষ সঙগ্রহ করে এই ঔষধি বনভূমি তৈরি করেছিলেন। উদ্ভিদ গবেষকদের মতে প্রায় ৪৩০ টি প্রজাতির ঔষধি বৃক্ষ এই বনভূমিতে পাওয়া যায়। এছাড়া নানা প্রজাতির সরীসৃপ, ইঁদুর, বনবিড়াল, হনুমান প্রভৃতির সাথে ডাহুক, টিয়া, বুলবুলি, কোকিল, কুব্ কুব্ আর বউ কথা কও পাখির দেখা মেলে এই অভয়ারণ্যে। সমগ্র মন্দির এলাকাটি চিল্কিগড় রাজ পরিবারের দেবত্তোর সম্পত্তি হলেও বর্তমানে তার দেখভালের দায়িত্বে আছে মন্দির উন্নয়ন কমিটি।





কলকাতা থেকে চিল্কিগড়ের দূরত্ব প্রায় ১৮২ কি মি এবং ঝাড়গ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে মাত্র ১৬ কি মি। ঘন শাল- পিয়ালের অরন্যে ঘেরা চিল্কিগড় শুধু ভারতীয় নয় , বিদেশি পর্যটকদের কাছেও বেড়াবার এক আদর্শ স্থান।





No comments:

Post a Comment