Thursday, 11 March 2021

ডাবুক -- বীরভূমের অচেনা এক শৈবতীর্থ

 ডাবুকেশ্বর শিবমন্দির---- ডাবুক---- বীরভূম




যাঁরা বেড়াতে ভালবাসেন,  যাঁরা বাংলার আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে বাংলাকে সঠিক ভাবে চিনতে চান, তবে সাপ্তাহিক ছুটিতে একটা ছোট্ট ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পরুন পায়ে পায়ে বাংলাকে দেখবার জন্য। এতে রোজকার হাপিয়ে উঠা জীবন থেকে সাময়িক মুক্তি পাবেন। পারবেন ইচ্ছামতন বাংলার গ্রামের তাজা বাতাস গ্রহন করে নিজের জীবনী শক্তিকে ফিরিয়ে আনতে। চলুন যাই বীরভূমের এক গ্রামে যার নাম  ডাবুক। 




এটি হ'ল বীরভূমের প্রত্যন্ত এক গ্রাম।  বীরভূমের খ্যাতি শক্তিপীঠ হিসাবে। শক্তিপীঠ হিসাবে বীরভূমের খ্যাতিলাভ করলেও শৈবতীর্থ বক্রেশ্বর ছাড়া আরও অনেক শৈবতীর্থ বীরভূমে বিরাজ করছে যার মূল্য কম নয়। এইসব তীর্থস্থানগুলি যেমন প্রাচীন,  তেমনই ঐতিহ্য মন্ডিত। এরকমই এক প্রচারবিহীন অথচ ঐতিহ্য পূর্ণ প্রাচীন মন্দির ডাবুকেশ্বর শিবমন্দির যেটি এই ডাবুক গ্রামে অবস্থিত। আবার বাবা মহাদেব এখানে উন্মত্তেশ্বর নামেও পরিচিত। 
 
বীরভূমের সর্বোচ্চ শিবমন্দির এটি। এই রকম অজ গায়ে এরকম শিবমন্দির অথচ তার মাথায় বীরভূমের সবচেয়ে উঁচু  মন্দিরের তকমা। প্রায় ৮০ ফুট উচু মন্দিরটি গম্ভীর,  একাকী ও উদাসীন।  আবার খুব অল্প কথায় বলা যায়___ এ এক অনন্য এবং অদ্বিতীয়। তারাপীঠ থেকে খুব বেশি দূরে নয়। কিন্ত তারাপীঠ তারা মায়ের সৌজন্যে আজ যতটা যমযমাট , ঠিক ততটাই নিষ্প্রভ এই ডাবুকেশ্বর শিবমন্দির। 




তবে এবার যেনে নেওয়া যাক  এই মন্দির প্রতিষ্ঠার পিছনের ইতিহাস।  কেউ কেউ বলেন-------- কৈলাশানন্দ স্বামী নামে এক সন্ন্যাসী ছিলেন ডাবুকেশ্বরের পরম ভক্ত।  তিনি দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়াতেন এবং দু এক বছর পর ফিরে এসে বাবার ভাঙ্গা মন্দিরে পড়ে থাকতেন।  শেষ জীবনে কৈলাশানন্দ স্বামী তাঁর আজীবন ভিক্ষালব্ধ ও সঞ্চিত লক্ষাধিক টাকায় ডাবুকেশ্বর মন্দির,  বাঁধানো  প্রাঙ্গন,  অতিথিশালা সব কিছু তৈরি করেন।  " সাধারণত  সন্ন্যাসীরা সাধারণ মানুষের মত সঞ্চয়ী হয় না "------তাই এই কাহিনী বিশ্বাস করতে অনেকেই   দিধা বোধ করেন।   অপর কাহিনীটি হ'ল----- কাশ্মীরের 
রাজমহিষী নি:সন্তান ছিলেন। কৈলাশানন্দ স্বামীর নির্দেশ মতো রাজমাতা ডাবুকেশ্বর শিবের নিকট সন্তান কামনা করেন এবং পুত্র সন্তান লাভ করেন। আনন্দিত ও যারপরনাই খুশি হয়ে মহারাজা প্রাচীন মন্দিরের পরিবর্তে ১২৮৭ বঙ্গাব্দে নতুন মন্দি্র তৈরি করে দেন।



পুরান ঘাটলে এইরকম জানতে পারি ..... পান্ডবদের অঞ্জাত বাসের সময় পান্ডবরা  ডাবুক গ্রামে এসে উপস্থিত হন, কিন্ত ডাবুকের গ্রামবাসীদের থেকে যথাযথ আতিথেয়তা না পাওয়ায় কুন্তী শিব কে অভিশাপ দেন "  আমার যেমন অন্ন জোটেনি  তেমনই তোমারও জুটবে না। "  এই কারনে বহুদিন এই উন্মত্তেশ্বর বাবার পূজা বন্ধ ছিল। পরবর্তীকালে বামাক্ষ্যাপার গুরুদেব বাবা কৈলাসপতি স্বপ্নাদেশ পেয়ে পূজা পুনরায় চালু করেন। বাবা কৈলাসপতি এখানেই সাধনা করেন এবং তাঁর দর্শন করবার জন্য বামদেব মাঝে মাঝে এখানে পদার্পণ করতেন।

এই মন্দিরের শিবলিঙ্গ পাতালভেদী | মাটির প্রায় ৪০ ফুট নীচে গর্ত খুঁড়েও এর তল পাওয়া যায় নি | এখানে বাবার অন্নভোগ হয় | লাগোয়া মন্দিরে বাবা কৈলাসপতি ,মা আনন্দময়ী  তারা মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত আছে | তারা মায়ের এখানে নিত্য আমিষ ভোগ হয় |

মন্দিরটির গঠনশৈলী বাংলার চারচালা রীতির হলেও প্রবেশ ও আবেষ্টনীর কাজ সদূর কাশ্মীরকেই মনে করিয়ে দেয়। একদা এই মন্দিরের ব্যায় নির্বাহের জন্য বার্ষিক ৬০০ টাকা বৃত্তির বরাদ্দ করেছিলেন কাশ্মীররাজ। এই মন্দিরের প্রধান উৎসব শিবরাত্রি ও চড়ক। শিবরাত্রি উপলক্ষে এখানে সপ্তাহব্যাপী একটি মেলা বসে ও প্রচুর লোকের সমাগম হয়। 

এই গ্রামের অবস্থান তারাপীঠের থেকে বেশী দূরে নয়। প্রায় ১৫-১৬ কি মি হবে। রামপুরহাট-সাইথিয়া বাসে শাসপুরে নেমে টোটো, অটো বা ভ্যান রিকশায় এই গ্রামে যাওয়া যায়। অথবা তারাপীঠ থেকে সরাসরি গাড়ি করে এখানে চলে আসতে পারেন। দুপাশের গাঢ় সবুজ ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে রাঙ্গা পথটি চলে গিয়েছে অনেক  দূর। গাছপালার ফাক ফোকর দিয়ে দু একটা বাড়ির আভাস পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে খেত শেষ হয়ে গিয়ে এবরো খেবরো মেঠো পথ। পথের পাশে পুকুরে হাঁসেদের ডুব দেওয়া বা গুগলি তোলা বা সারিবদ্ধ ভেসে যাওয়া দেখতে দেখতে আপনার  মনে হবে___ জলে যেন কেউ আলপনা দিয়ে দিয়েছে। মনে হয় এ পথ যেন শেষ না হয়। কিন্ত এসব দৃশ্যের অবসান হয়ে দৃশ্যমান হয়ে উঠে ডাবুকেশ্বর শিবমন্দির। গ্রামেবাংলার বৈশিষ্ট্যহীন সাদামাটা এক গ্রামে নিভৃতে একাকী সবার অলক্ষে প্রচারবিহীন হয়ে দাড়িয়ে রয়েছে এই মন্দির। 

অপূর্ব সুন্দর  শান্ত এই স্থানে গিয়ে  বাবা ডাবুকেশ্বর  তারা মায়ের দর্শন করে প্রসাদ পেতে পারেন। |








No comments:

Post a Comment