Saturday, 23 July 2022

পাহাড়ি সুন্দরী তাবাকোষি

 


দেখে আসুন পাহাড়ি  সুন্দরী তাবাকোষিকে  ~~



সকালে কোনোরকমে খাওয়া-দাওয়া সেরে সারাদিন  অফিসের ব্যস্ততার মধ্যে কাটিয়ে রাতে বাড়ি ফেরা, ফের পরের দিন  আবার সেই ....... দিনের পর দিন জীবনের এই একঘেয়েমি রুটিন থেকে মুক্তি পেতে যাদের মন দূরে কোথাও যেতে খুব উতলা হয়ে উঠেছে, তারা চলে আসতে পারেন উত্তরবঙ্গের ছোট এক পাহাড়ি গ্রাম তাবাকোষিতে। বেশী দূরে নয়। মিরিক থেকে ৮ কি মি দূরে বা এন জে পি থেকে ৬২ কি মি দূরে ৩৬০৮ ফিট উচ্চতায় প্রকৃতির আশীর্বাদ পুষ্ট এই গ্রাম কতগুলো চা বাগানের মাঝে এক অপরুপ সুন্দর নদীকে কোলে করে অবস্থান করছে। হঠাৎ নাম শুনলে এর হয়তো অনেকেই ভাবতে পারেন জায়গাটি জাপানের কোনো এক অঞ্চলে। কিন্তু আসলে এটা উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং পাহাড়ে অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রাম। মিরিক, দার্জিলিং, কার্শিয়াঙ বা কালিম্পং এর সাথে যেখানে পাত্তাই পায় না। এটাই এই পাহাড়ের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা। কিন্তু তাতে কি হবে, এখনও প্রায় আড়ালেই রয়ে গিয়েছে এই জায়গা। এক কথায় বলা যেতে পারে প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে এটি স্বর্গরাজ্য। জনপদের হট্টগোল কাটিয়ে শুধু সিনিক বিউটির জন্য সেরা ডেষ্টিনেশন।




এই তাবাকোষি নামটি তৈরী হয়েছে দুটি নেপালী শব্দ থেকে। "তাবা" মানে তামা আর "কোষি" মানে নদী। এই  জায়গাতে পাহাড়ের গা বেয়ে চা বাগানের মাঝখান দিয়ে যে পাহাড়ি নদী বয়ে চলেছে তার নাম রঙ্গন  খোলা। এর চলতি নাম রংভং। আবার এটিরই নেপালি নাম  তাম্বাকোষি। বর্ষাকালে যখন বৃষ্টি বেশি হয় তখন এই নদীর জলে কাদা গুলে গিয়ে জল তামাটে বর্ণ ধারণ করে।তাই তামাটে জলের এই নদীকে নেপালি ভাষায় তাম্বাকোষি বলে। চলতি কথায় লোকের মুখে মুখে এর নাম তাবাকোষি হয়েছে। আর তার সাথে গ্রামের নাম হয়েছে তাবাকোষি।




এটি পোখরিয়াবং রংভং ভ্যালির নিচের অংশ যাকে 'চা' এর গ্রাম বললে ভুল হবে না। কেননা এটি পৃথিবী বিখ্যাত আটটি চা বাগান যথাক্রমে গোপালধারা, সিয়ক,  টুরজুম,  সাঙ্গমা,  চামং,  মাগারজং, থারবো  আর নাগরী চা বাগান দিয়ে ঘেরা। এই চা বাগানগুলি ১০০ বছরেরও বেশী পুরোনো। বেশিরভাগ বাগান ১৮৫৭ সাল থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে তৈরী হয়েছিল। গ্রামের বুক চিরে বয়ে চলেছে রংভং নদী। নদীর পরিষ্কার জলে স্নান করতে পারেন বা পাথরে বসে পা ডুবিয়ে ঠান্ডা জলের সাথে .....যাকে বলে জলক্রীড়া করতে করতে নদীর আওয়াজ শুনতে পারেন। এর সাথে রয়েছে নাম না জানা পাখিদের ডাক যা শুনতে শুনতে সামনের পাহাড়ের ঢালে সবুজে ঘেরা চা বাগানের মধ্যে আপনি কখন যে হারিয়ে যাবেন , নিজেও তা টের  পাবেন না। যাদের শখ আছে , তাঁরা হোমষ্টের মালিককে বললে মাছ ধরার ব্যবস্থাও করে দেবেন। এছাড়া যাঁরা প্রকৃতি প্রেমিক তারা এই সুন্দরী নদীর ধার ধরে ধরে নদীর সাথে তাল রেখে মাইলের পর মাইল হেটে এগিয়ে যেতে পারেন। আর আপনি যদি হই হুল্লোর করতে ভালো বাসেন, তবে একদিন নদীর ধারে বসে ইচ্ছামতন রান্নাবান্না করে আপনার পিকনিকটা সেরে ফেলতে পারেন। আবার যদি মনে হয় প্রকৃতির সাথে নিজেকে মিলিয়ে থাকবেন, তবে নদীর পাশে টেন্ট করে   দু  একটা দিন কাটাবারও অনেক জায়গা পেয়ে যাবেন। 





১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর মাসে হিল কাউন্সিলর চেয়ারম্যান সুভাষ ঘিসিং মহাশয় তাবাকোষি টুরিয়িজিমের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। কিন্ত সেখানেই থেমে থাiকে শুধুমাত্র যাতায়াতের ভালো বন্দোবস্ত অর্থাৎ ভালো রাস্তা না থাকার জন্য।  তিনিই রংভং নদীর উপর পুরোনো ব্রীজ সরিয়ে নতুন লোহার ব্রিজের বন্দোবস্ত করেন।  আর ব্রিজের নাম দেন মুক্তি ব্রীজ।  ২০১৪ সাল থেকে যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি সাধন হতে থাকে। প্রচার মাধ্যমে আসে যাতে কিনা ভ্রমন পিপাসুদের যাতায়াতের পথ সুগম হয় । আর এই থেকে ভ্রমনার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।






পাহাড় মানে এক এক ঋতুতে এক এক রুপ। শীতে কখনো মেঘমুক্ত ঔজ্জ্বল্য, কখনো বা মেঘের ঘোমটায় নিজেকে ঢেকে রাখা। গ্রীষ্মে যখন তখন বৃষ্টি বা দুপুর রাতে বৃষ্টির মূর্ছনা। তার যে আবহসঙ্গীত মোটেও তা কখনো এক ভাবে বাজে না। কখনো বা টুপটাপ। কখনো বা বর্ষনের ঝম ঝম আওয়াজ। আবার পাহাড়ের দিনে এক রুপ আর রাতে আর এক রুপ। চা বাগান, তাবাকোষির দিগন্তে মিশে রয়েছে। সেই সবুজ রঙের কত রকম প্রকার ভেদ। কোথাও গাঢ় সবুজ, কোথাও হালকা বাদামী সবুজ, কোথাও বৃষ্টি ভেজা সবুজ, আবার কোথাও রোদ্দুর সবুজ .......... নীল আকাশের নীচে যে সবুজের কত শেড তা দেখতে দেখতে আপনার দিন ফুরিয়ে যাবে। তারপর নেমে আসবে অন্ধকার।  তাবাকোষির রাতের সৌন্দর্য দেখার মতো। পাহাড়ের গায়ে দূর জনবসতির আলোগুলো জোনাকির মত দেখতে লাগে। রাতের মায়াবি পরিবেশ না দেখলে পরবর্তীসময়ে আপনার মনে আক্ষেপ হতেই পারে।







যেহেতু তাবাকোষি গ্রামটি পাহাড়ের একটি offbeat location, সেহেতু এখানে থাকার জন্য  হোটেল পাবেন না। তবে এখানে থাকার জন্য সুসজ্জিত ও ঘরোয়া নিরামিষ  বা আমিষ খাওয়ার ওয়াল কিছু হোমষ্টে পাবেন। প্রত্যেক হোমষ্টের ঘরগুলি আয়তন বড়, সুন্দরভাবে সাজানো আর ঘরগুলির বড় বড় জানালা থেকে বাইরের পাহাড়ের শোভা সহজেই দেখা যায়। সারাদিনের খরচ চারবেলা খাওয়া দাওয়া সহ ১৫০০ থেকে ২২০০ টাকার মত জনাপ্রতি। ভারী কাঁসার থালায় সাজানো ভাত, ডাল, রাইশাক, কোয়াশের তরকারি আথবা কোয়াশের শাক দিয়ে তৈরী সুন্দর এক নিরামিষ সব্জী। এর সাথে পাবেন দিনের বেলায় ডিম আর রাত্রে চিকেন। সন্ধ্যায় চায়ের সাথে রয়েছে পকোরা  বা মোমো। সকালে রয়েছে লুচি বা পরটা বা রুটির সাথে সুস্বাদু এক তরকারি  আর ডিমের মামলেট। মেনু সর্বত্র প্রায় এক।






তাবাকোষিতে বছরের যে কোনো সময় আসা যায়। বর্ষাকালে এলে ফুলেফেপে উঠা রংভং নদীর রুপ ও তার গর্জন আপনাকে একটু শিহরিত করবেই করবে। যেহেতু খুব বেশী উচ্চতায় অবস্থিত নয়, তাই শীতকালে এখানে ঠান্ডা খুব বেশী হয় না। আর গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড গরম থেকে রেহাই পেতে , সকাল সন্ধ্যায় হালকা ঠান্ডার অনুভূতি পেতে, চলে আসতে পারেন তাবাকোষিতে। এখান থেকে জোড়াপখড়ি, লেপচাজগৎ, পশুপতি মার্কেট ( যেটা ভারত নেপাল সীমান্তে) , গোপালধারা বা আশেপাশের আরও ৬ - ৭টা বাগান, মিরিক লেক, মিরিক মনষ্ট্রী ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা দেখতে পারবেন। দেখতে পাবেন ৫ কি মি দূরে গোলপাহাড় যেখানে প্রকৃতি নিজেকে এমনভাবে সাজিয়েছে যেন কোনো আধুনিক যুবতীর সাজও তার কাছে হার মেনে যায়। গোল গোল পাহাড়ের গায়ে গোপালধারা বা গুডরিক চা বাগানের চা গাছগুলি এমনভাবে নিজেরা দাড়িয়ে রয়েছে, দূর থেকে মনে হবে কোনো এক চিত্রশিল্পীর আঁকা সবুজ এক কার্পেট। সঙ্গে নিস্তব্ধতা আর নিরবতা চা বাগানগুলিকে আগলে রেখেছে।










দার্জিলিং,  মিরিক বা কার্শিয়াঙ-এর মতন জনসমাগম এখানে নেই।  সেজন্য তাবাকোষি নিজের সৌন্দর্য ধরে রাখতে পরেছে। নিজেকে বিকশিত করে রেখেছে অপরকে অনাবিল আনন্দ দেবার জন্য।  তাই তাবাকোষি এমনই একটি জায়গা যেখানে আপনার ধকল হওয়া ক্লান্ত চোখ শিথিল হবে আর অবসাদ অবসাদগ্রস্থ হৃদয় খুজে পাবে আনন্দের উৎস।  তাবাকোষির প্রকৃতিক সৌন্দর্য ও নিরিবিলি পরিবেশ আপনার মনের সব চিন্তা মুক্ত করে মনে শান্তির অনুভূতি এনে দেবে যার ফলে এই জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে মন চাইবে না। যারা শান্তশিষ্ট পরিবেশে কিছুদিন পাহাড়ে কাটাতে চান তাদের কাছে এ এক আদর্শ জায়গা। তাই আমাদের যান্ত্রিক শহুরে জীবন থেকে কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়ে যদি এই রকম প্রকৃতির মাঝে আমরা কিছুটা সময় কাটিয়ে আসি তাহলে আমাদের শরীর ও মনের সজীবতা কয়েকগুন বেড়ে যাবে যা কিনা পরবর্তী দিনগুলিতে চলার পথে এক নতুন উদ্দম নিয়ে আসবে। তাই  কাছাকাছি কোনো ছুটির খবর থাকলে চট করে একবার ঘুরে আসতে পারেন  তাবাকোষি থেকে।












14 comments:

  1. Comment made by Mr SB Ray ::

    খুব সুন্দর বর্ণনা। পড়তে পড়তে মনে হলো নিজেই যেন তাবাকোষিতে বেড়াচ্ছি। লেখার সঙ্গে সুন্দর সুন্দর সব ছবি, দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। অনবদ্য, কোনো কথা হবে না। .... শচী বিলাস রায়।

    ReplyDelete
  2. Mr Shyamal Kuthial reacted in this manner ~~~

    দারুণ দারুণ.... যাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে এখনই....

    ReplyDelete
  3. শ্রী হরদাস চক্রবর্তী মন্তব্য করেছেন এই ভাবে ------

    ছবি এবং লেখা অনবদ্য। ভাষা দিয়ে ছবি ফুটিয়ে তোলা আর ছবি দিয়ে বোঝান কাকে ছেড়ে কাকে নম্বর দেব ধন্ধে পরে যাচ্ছি। দুই এর সঙ্গত্ একদম একই ক্যানভাসে সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে। মনে হয় এখনই ছুটে চলে যাই। এখানেই মুন্সিয়ানা। আবার বলি অপুর্ব।

    ReplyDelete
  4. Mr Subhendu Majumder has told **********
    So wonderful!

    ReplyDelete
  5. Mr Amit Bhattacharya's comment as noted below::

    Darun lekha o chhobi

    ReplyDelete
  6. Mr Somesh Bose described as __

    Daroon.

    ReplyDelete
  7. শ্রী মতি মীনা দে নিজের ভাব প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন -------

    Daroon, amader k o nijer saathey niye chalo

    ReplyDelete
  8. মহুয়া চৌধুরী কি বলেছেন ........

    Khub sundar

    ReplyDelete
  9. শ্রীমতি রুপালি রায় -এর মন্তব্য ~~~

    আপনার অপূর্ব লেখনী আর ছবি র মধ্যে দিয়ে সুন্দরী তাবাকোষি আরও অপরূপ হয়ে উঠেছে।

    ReplyDelete
  10. শ্রীমতি রত্না মাইতি কি বলেছেন -----

    Apurba barnona.

    ReplyDelete
  11. শ্রী কল্লোল বসু মহাশয়ের মূল্যবান মন্তব্য এই রকম *******

    প্রথমত লেখাটা পড়ে দেখতে পারিনি কারন ওটা খুলছিল না।
    আজ একটু আগে পড়লাম।এর আগেও বলেছি আপনি মে কোনো ভ্রমণ ম্যাগাজিনে লিখতে পারেন।এত তথ্য ভিত্তিক লেখা এবং এত দেখার চোখ খুব কম লোকেরই থাকে।চোখ থাকলে ই হয়না চাই দেখার দৃষ্টি।সেটা আপনার আছে।
    তাই ধন্যবাদ দিলে ছোট করা হয়।
    প্রনামানতে

    কল্লোল।
    26/7/22.

    ReplyDelete
  12. Comment from Mr Samanway Sen ::::

    Beautiful description.

    ReplyDelete
  13. শ্রীমতি সন্ধ্যা বোস লিখেছেন -------

    খুব ভালো লাগলো পড়ে দারুন বর্ণনা দিয়েছেন জায়গার যাবার খুব ইচ্ছা রইল।

    ReplyDelete
  14. শ্রী অমিত চক্রবর্তী (জয়) মন্তব্য করেছেন::

    Darun jaiga.Prothom bar naam sunlam.Kintu description pore r picture dekhe khub bhalo laglo.Tomar blogging darun.

    ReplyDelete