জঙ্গলমহলের এক রূপকথা ______ গাঁয়ের নাম খোয়াব গাঁ_______ ঝাড়গ্রাম।
ঝাড়গ্রামে কাজুবাদাম আর আকাশমনির জঙ্গলের ভিতরে স্বপ্নের গ্রাম খোয়াব গাঁ। অবশ্য এই গ্রামের নাম আগে খোয়াব গাঁ ছিল না। "লালবাজার" নামেই শহরের অদূরে এই গ্রাম পরিচিত ছিল। ঝাড়গ্রাম রেল স্টেশন থেকে পুলিশ লাইনের মেন রোড ছেড়ে কেনেল পাড়ের রাস্তা দিয়ে সোজা কাজুবাদাম আর আকাশমনির গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মোরামের উঁচুনিচু রাস্তা ধরে প্রায় চার পাঁচ কিলোমিটার এগিয়ে গেলে পথের শেষে পাওয়া যাবে এই গ্রাম। তবে এই লালবাজার কথার মধ্যে যেন পুলিশ পুলিশ একটা গন্ধ রয়েছে। তাই গ্রামবাসীর সন্মতিতে ২০১৮ সালের শেষে নাম বদলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর প্রধান উদ্যোক্তা হলেন চালচিত্র অ্যাকাডেমির সম্পাদক শিল্পী শ্রী মৃণাল মন্ডল। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যিক শ্রী শিবাজী বন্দোপাধ্যায় " খোয়াব গাঁ" নামটি ঠিক করে দেন। গ্রামে শিল্পচর্চার মাধ্যমে যে স্বপ্ন বা খোয়াব বোনা হচ্ছে ---- এই নাম তারই সার্থক প্রতিফলন।
ঝাড়গ্রাম ব্লকের রাধানগর পঞ্চায়েতের অধীন এই গ্রামে মোট ১৩ টি পরিবারের বাস। এর মধ্যে ১২টি পরিবারই লোধ সম্প্রদায়ের। রয়েছে একটি কুর্মি পরিবার। গ্রামের জনসংখ্যা মাত্র ৭৫ জন। এই ছোট্ট গ্রামের বসতি গড়ে উঠার কাহিনীটি এই রকম -------- ঝাড়গ্রামের মল্লদেব রাজাদের চাষের জমি ছিল স্থানীয় অর্জুনডহড়, রাজবাধ আর মধুপুর মৌজায়। পঞ্চাশ দশকের কিশোর কালীপদ অহির , অধুনা প্রবীন বাসিন্দা, বাবার সাথে এসেছিলেন রাজাদের জমিতে খেতমজুরি করতে। পরে রাজপরিবারের তরফে তাঁকে থাকার ঘর দেওয়া হয়। সেদিনের কালীপদ লালবাজারের সংসার পাতেন। খেতমজুরের কাজে আসা লোধেরা রাজানুগ্রহে এলাকায় থিতু হয়ে যান।
খেটে খাওয়া লোধ জনজাতির বাসিন্দারা কিছু দিন আগে পর্য্যন্ত সংসার চালাতে হিমশিম খেতেন। জঙ্গলের ডালপালা কেটে তা সংগ্রহ করে বিক্রি, নয়তো খেতমজুর কিংবা দিনমজুরের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি, বা মরশুমে ভিন্ জেলায় 'নামাল' খাটতে যাওয়া। তাঁদের এই দিন-আনির সংসারে লড়াইটা ছিল খিদের সাথে। এমনিই একটা গ্রাম খুঁজছিলেন মৃণালবাবু। ২০১৮ সালের শেষ নাগাদ মৃণালবাবু খুঁজে পেলেন এই লালবাজার যেখানে পরীক্ষা মূলক ভাবে শিল্পচর্চার মাধ্যমে জনজাতির মানুষজনের জীবনে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন আনা যায়। তিনি এবং তাঁর সহযোগীরা এই গ্রামেই গড়ে তুললেন " ওপেন ষ্টুডিয়ো "। প্রথমে ট্রান্সপারেন্ট শিটের উপরে আঁকা ছবির উপরে টর্চের আলো ফেলে চলচ্চিত্রের মতো ছবি দেখানো হল। হাতে কলমে দেখানো হল কি ভাবে কাজটা করা হয়েছে। তাতে বেজায় মজা পেলেন গ্রমবাসীরা। তাদেরকে ফুল, পাতা, কাঁচা হলুদ, বেলের আঠার মতো প্রাকৃতিক ও ভেষজ উপাদান দিয়ে প্রকৃতিক রং তৈরি শেখানো হলো। শুকনো ছাল-বাকল-শিকড়ের মধ্যে শিল্প আবিষ্কারের " চোখ " তৈরির কাজ গ্রামবাসীরা শিখলো। সাথে সাথে মৃণালবাবু চেষ্টা চালিয়ে গেলেন নতুন প্রজন্মের কাছে পড়াশুনার গুরুত্ব বোঝাতে। এরই ফল হিসাবে গ্রামবাসীরা শপথ নিতে শিখেছে " শিখব, পড়ব, জানব, স্কুলছুট হব না "। বেশিরভাগ পরিবারের নারী পুরুষ জঙ্গলের কাঠ কেটে মাথায় বয়ে নিয়ে গিয়ে মহাজনদের কাছে বিক্রি করে সংসার চালাতেন। কিন্তু জঙ্গল ফুরিয়ে গেলে কি কি সমস্যা হতে পারে সেগুলো তাদেরকে বোঝানো হল। আর এর কিছুদিন পরেই এর সুফল পাওয়া গেল। বাসিন্দাদের রোজকার জীবনেও এখন পরিবর্তন এসেছে। গ্রাম পরিচ্ছন্ন রাখেন বাসিন্দারা। গ্রামের খুদেরা সময় পেলেই দেওয়ালে-দরজায় ছবি এঁকে ভরিয়ে দেয়। বাঁশ কাঠের তৈরি ময়ূর, গনেশের মুখ, কাকড়া বিছে_____ এগুলোর নাম কাটুম কুটুম। শিশুরাই এগুলো বানায়। পর্যটকেরা গ্রামে এসে কিনে নিয়ে যান লোধ শিল্পদের তৈরি কাটুম কুটুম, মাটির পুতুল, ছবি ইত্যাদি। এক সময় জঙ্গলজীবি মানুষজন রুজির টানে বনজ সম্পদ বিক্রি করে সংসার চালাতেন। এখন তারাই জঙ্গল রখ্খা করেন। তাদের এখনকার প্রতিঞ্জা --- " আমরা সারা জীবন যত গাছ কেটেছি, তার থেকেও অনেক বেশি গাছ লাগানোর প্রতিঞ্জা করছি " ।
এরই মাঝে কথায় কথায় এক প্রবীনের মুখে আখ্যেপের সুর বেজে উঠলো। তিনি জানালেন " আমাদেরও যে সন্মান থাকতে পারে, সেটা আগে কখনোও ভাবিনি। ছোটবেলায় শুনেছি বাপ-ঠাকুরদাকে প্রতি সপ্তাহে থানায় হাজিরা দিতে হতো। আমরা নাকি অপরাধী জাতি। এক সময় বিদেশিরা আমাদের অপরাধ প্রবণ তকমা দিয়েছিল, এখন সেই বিদেশি লোকজন আমাদের শিল্পের প্রসঙসা করেন, জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যান "।
সত্যি বলতে কি ঝাড়গ্রাম ট্রাফিক পুলিশ বা আপনার ওখানকার বেড়ানোর গাড়ীর ড্রাইভার বা স্থানীয় অনেক লোকই এই রূপকথার গ্রাম সম্পর্কে অবগত নয়। হতাশ হবার কিছু নেই। ঐ গ্রাম তো রয়েছে _____ শুধু মাত্র লোকচক্ষুর অন্তরালে তিলে তিলে গড়ে উঠছে সেই রূপকথা।
ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই গ্রাম। অনেকেই হারিয়ে যেতে আসছেন এই কাজুবাদাম আর আকাশমনির জঙ্গলের ভেতর। ইচ্ছে হলে আপনিও কিছুদিন কাটিয়ে যেতে পারেন। বাংলার লোকজীবন আর ছবি যদি আপনাকে আকর্ষন করে -------- এই গ্রামের হাতছানি তাহলে আপনি কিছুতেই এড়াতে পারবেন না।
No comments:
Post a Comment