বাল্মীকির আশ্রম ---- তপোবন
যে বনে মুনিঋষিরা তপস্যার জন্য বাস করতেন, সে বনই হলো তপোবন । তপোবন কোনোও নির্দিষ্ট জায়গার নাম নয়। তপস্যাসাধনের বনই হ'ল তপোবন। পুন্যভূমি ভারতবর্ষে কতই না আছে তপোবন। ভারতবর্ষ মুনিঋষিদের দেশ। যেখানেই সত্যদ্রষ্টা মুনিঋষিদের আশ্রম স্থাপিত হয়েছে বা পুন্যাত্মা মুনিঋষিদের বানী বর্ণিত হয়েছে, সেটিই তপোবন বলে নামকরন হয়েছে। এখানে যে তপোবনের কথা বলতে চলেছি _____ এ তপোবন রত্নাকর দস্যুর তপোবন। ভয় পাবার কিছু নেই। কেননা আজ কোনো দস্যুও নেই, আর সেজন্য লুটপাট হবারও কোনো ভয় নেই। তবে বনের মধ্যে , আপনার ভাগ্য যদি সুপ্রসন্ন থাকে , তবে হাতির পালের দেখা মিলতেও পারে। এ দেখে আপনি মজা পাবেন না ভয় পাবেন সেটি আপনার নিজস্ব ব্যাপার।
ঝাড়গ্রাম শহর থেকে প্রায় ৬৫ কিমি দূরে দেউলবাড় গ্রামে গেলে দেখতে পাবেন রামেশ্বর শিব মন্দির। সেই শিবমন্দির থেকে ৭ কিমি দক্ষিনে সুবর্ণরেখা নদীর ধারে গভীর জঙ্গলের মধ্যে রয়েছে অপরূপ সুন্দর এক জায়গা ----- বাল্মীকির তপোবন। হাত বাড়ালেই সুবর্ণরেখা নদী। আর জঙ্গলের রূপকে তো এককথায় অপরূপ বলা যায়। খড়্গপুর, মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম বা বেলদা থেকে কালো পিচের রাস্তা আর সবুজ শাল গাছের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কিংবা সবুজ জঙ্গল আর রঙ্গিন মোরামের রাস্তা ধরে চলতে চলতে আপনি কখন যে পৌচ্ছে যাবেন নিজেও বুঝতে পারবেন না। সড়কপথে চড়াই উতড়াই হলেও এ পথের শোভা আর তাজা অক্সিজেন পাওয়ার আনন্দ, আমার মনে হয়, আপনার চিরকাল মনে থাকবে।
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। আর বিশ্বাসই ভারতীয় সভ্যতার প্রানভোমরা। এই বিশ্বাসেই ভারতবর্ষের সর্বত্র রামায়ণ মহাভারতের অধিষ্ঠান। রামচন্দ্র, সীতা ও লক্ষনের সাথে বনবাসে যাওয়ার পথে বাল্মীকির তপোবনে কিছুটা সময় বিশ্রাম নিয়েছিলেন। এখান থেকে পঞ্চবটী বনে গিয়ে কুটির তৈরি করে থাকলেন। রাবণ সেখান থেকে সীতাকে চুরি করে। সীতাকে রাবনের হাত থেকে উদ্ধার করে চৌদ্দ বছর পরে রাজ্যে ফিরে এসে রামচন্দ্র যখন রাজা হয়েছিলেন, তখন প্রজারা গর্ভবতী সীতার চরিত্রে সন্দেহ প্রকাশ করেন। রামচন্দ্র প্রজাদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য সীতাকে পরিত্যাগ করেন। লক্ষণ সীতাকে পুনরায় অরন্যে বাল্মীকির তপোবনে রেখে আসেন। কিছুকাল পরে সীতার দুই জমজ সন্তান লব ও কুশ জন্মগ্রহণ করেন। তারা বাল্মীকি মুনির কাছে সর্ব শাস্ত্র অধ্যয়ন করে এবং যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হন। এই সময় রামচন্দ্রের অশ্বমেধের ঘোড়া যখন এই স্থান দিয়ে যায়, তখন লব-কুশ সেই অশ্বকে ধরে রাখে । ফলে রামচন্দ্র ও তাঁর তিন ভাইয়ের সাথে তাদের প্রবল যুদ্ধ হয়। লব-কুশের কাছে তারা সকলেই পরাজিত হয়ে চেতনা হারান। খবর পেয়ে সীতা ছুটে আসেন এবং এসব দেখে কান্নাকাটি আরম্ভ করেন। সীতার কান্না শুনে বাল্মীকি মুনি আসেন ও মন্ত্রপুত জল ছিটিয়ে তাদের চেতনা ফেরান । লব-কুশকে অশ্বমেধের ঘোড়া ছেড়ে দিতে বলেন। বাল্মীকির কথায় লব-কুশ ঘোড়া ছেড়ে দেন।
সীতানালা নামে একটা ছোট অরন্য ঝর্ণা তিন দিক থেকে তপোবনকে ইউ-এর মতো ঘিরে রয়েছে। আর একদিকে সুবর্ণরেখা নদী। কথিত আছে, বনবাসে থাকার সময়ে সীতা এই নদীতে স্নান করতেন বলে এই নদীর নাম সীতানালা। তপোবনে ঢোকার জন্য খালের উপরে এখন কংক্রিটের সেতু হয়েছে। আগে কাঠের সেতু ছিল। সেতু পেরিয়ে একটু এগোলেই মহর্ষি বাল্মীকির সমাধি। সমাধির নিচ থেকে মাকড়া পাথর সাজিয়ে উড়িষ্যার রেখ দেউল রীতিতে একটি ছোট মন্দির চূড়া তৈরি করা হয়েছে। সমাধির উপরে একটি লম্বা-লম্বি চেরা শালগাছ রামধনুর মত দুপাশে মটি স্পর্শ করে আছে। এই শালগাছটির নাম হল সীতা দাঁতন। সীতা নাকি শাল দাঁতনে দাত মাজার পরে দাঁতন চিরে জিভ ছুলে ফেলে দিলে এই গাছের জন্ম হয় বলে এর নাম সীতা দাঁতন। সমাধির পাশেই একটা বেদির উপরে একটা হোমকুণ্ড আছে যার আগুন রাতদিন জ্বলতে থাকে। কেউ বলেন বাল্মীকির হোমকুণ্ড। আবার কেউ একে সীতাধুনি বলে সম্বোধন করেন। সীতার গর্ভে লব-কুশ জন্মানোর পর আঁতুড়ের পাশে সীতাদেবী শিশুদের উষ্ণতা প্রদানের জন্য এই ধুনি জ্বেলেছিলেন, তাই এটা সীতাধুনি নামে পরিচিত। নিয়ম হচ্ছে, এখানে যেই আসুক না কেন বন থেকে এক খন্ড কাঠ এনে এই ধুনিতে দিয়ে যেতে হয়।
উত্তরে সীতানালা আর দক্ষিণে সীতাকুন্ড থেকে নির্গত হলুদ জলের ঝর্ণা তপোবনকে বেস্টন করে একসঙ্গে মিলিত হয়ে চলে গেছে সুবর্ণরেখার দিকে। জনশ্রুতি, সীতা এখানে তেল হলুদ মাখিয়ে লব কুশকে নিয়মিত স্নান করাতেন বলে জলের রং হলদে হয়ে গিয়েছে। বাল্মীকির সমাধির পাশেই রয়েছে একটা ছোট্ট মন্দির যেখানে বাল্মীকি, রাম, লক্ষণ, সীতা, লব ও কুশের মূর্তি রয়েছে। একে সকলে বাল্মীকি মন্দির বলে। যেখানে লব-কুশ অশ্বমেধের ঘোড়া ধরেছিল তা এই আশ্রম থেকে প্রায় ৫ কিমি দুরে গভীর অরন্যের মধ্যে অবস্থিত। অরন্যের প্রবেশ পথের বাম দিকে একটি স্থানে একটা সিমেন্টের ঘোড়া তৈরি করে রাখা আছে। মনে হবে যেন এখানেই বাঁধা ছিল সেই অশ্বমেধের ঘোড়া। আশ্রমের একটু দূরেই সীতানালা পাশেই রয়েছে তিলক মাটির পাহাড়। সেখানে থেকে আপনি নিজের ইচ্ছামতন তিলক মাটি সংগ্রহ করতে পারেন। বাল্মীকি মন্দিরের কাছেই রয়েছে একটি মহাদেব মন্দির। আবার একটি বীর হনুমানের মন্দিরেরও নির্মাণের কাজ চলছে।
বাল্মীকি মন্দিরে রোজদিন অন্নভোগ হয়। যে কেউ মানসিক করে এখানে অন্নভোগ নিবেদন করতে পারেন। প্রতি পূর্ণিমায় এবং অষ্টমীতে মন্দিরে নাম সংকীর্তন হয়। মন্দির খোলা থাকে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত।
শ্রদ্ধা, ভক্তি ও বিশ্বাস দিয়েই মানুষ পৃথিবীতে তীর্থ রচনা করে। রামায়ণ বর্ণিত বাল্মীকির তপোবনের সঙ্গে এই তপোবনের কোনো সম্পর্ক আছে কি নেই , তপোবন দর্শনের জন্য সেই বিতর্কে না যাওয়াই ভালো। কিন্ত এই স্থানের প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশ যথার্থভাবেই প্রাচীন তপোবনের উপযুক্ত, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই।
No comments:
Post a Comment