মেদিনীপুর (বর্তমান ঝাড়গ্রাম) জেলার নয়াগ্রাম থানার দেউলবাড় গ্রামে মন্দিরটি অবস্থিত। সুবর্ণরেখা নদীর একেবারে পাড়ের উপর প্রায় পাঁচ একর জায়গা জুড়ে, নদীপৃষ্ঠ থেকে ১৫০ মিটার উচ্চতায় জঙ্গলাকীর্ণ জন বিরল স্থানে ওড়িষি ভাষ্কর্যে মাকড়া পাথরে নির্মিত এই প্রাচীন শিব মন্দির। মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছে একসঙ্গে বারোটি শিবলিঙ্গ। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৩৪ লখ্খ টাকা ব্যয়ে মন্দিরটিকে সুসজ্জিত করেছে।
রোহিনী নিকটে বারাজীত মহাস্থান।
রাতে সীতা-রাম-লখ্ণ কৈলা বিশ্রাম।।
দুয়াদশ লিঙ্গ রামেশ্বর শম্ভুবর।
রঘুবঙশ কুলচন্দ্র পূজিলা বিস্তর।।
সপ্তদশ শতাব্দীতে ১৬৫৫ সালের মধ্যে রচিত "শ্রী শ্রীরসিকমঙ্গল" নামক জীবনীকাব্যে রামেশ্বর শিবের উল্লেখ আছে। এর বর্ননায় দেখা যায় যে রোহিনীর কাছে বারাজিত নামক স্থানে দ্বাদশলিঙ্গের অবস্থান। রামেশ্বরের কাছে বনের মধ্যে তপোবন নামে একটি মনরোম স্থান বাল্মীকির আশ্রম রুপে পরিচিত। সীতা-রাম-লখ্ন এই তপোবনে বাল্মীকির আশ্রমে বিশ্রাম গ্রহনকালে যে শিবলিঙ্গকে পূজা করেছিলেন, সেই রাম পূজিত শিবের নাম রামেশ্বর শিব।
পুরাতত্ত্ব গবেষকদের একাংশের মতে, একাদশ-দ্বাদশ শতকে ওড়িষার চোল গঙ্গদেবের রাজাদের আমলে মন্দিরটি তৈরি হয়। এই মন্দিরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, সকালে একটি নির্দিষ্ট সময়ে সূর্যের প্রথম কিরণ মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করে চারপাশে আলোকিত করে তোলে।
একদিন ভগবান বিশ্বকর্মাকে ডেকে এক রাত্রির মধ্যে বাল্মীকির তপোবনের কাছে পুরী নির্মাণের আদেশ দিলেন___ মানুষ যাতে না যানতে পারে এমনভাবে পুরী তৈরি করতে হবে সকলের অগোচরে। তাই বিশ্বকর্মা রাত্রে মানুষ যখন ঘুমাচ্ছিলো তখন এখানে এসে স্থানীয় মাকড়া পাথর দিয়ে মন্দির গড়তে শুরু করেন। বাইরে থেকে ভালো ভালো পাথর এনে মন্দির নির্মাণ যেহেতু এক রাত্রে সম্ভব নয়, তাই স্থানীয় মাকড়া পাথর ব্যবহার করেছিলেন। মন্দিরের কাজ প্রায় শেষ করে প্রাচীরের কাজ শুরু করেছেন, এমন সময় শুনতে পেলেন যে চিড়াকুটিরা ঢেঁকিতে চিড়া কুটতে শুরু করেছে। বিশ্বকর্মা ভাবলেন, সকাল হয়ে গেছে, এবার লোকজন তাকে দেখে ফেলবে। ভয়ে তিনি মন্দিরের কাজ অসম্পূর্ণ রেখে স্বর্গে ফিরে গেলেন। কিন্ত তিনি জানতেন না, চিড়াকুটিরা সকাল হওয়ার এক প্রহর আগে উঠে নিজের ঘরে চিড়া কুটে।
সুবর্ণরেখা তীরে রামেশ্বর শিব ।
সূর্য কিরণে দ্বাদশ লিঙ্গ স্নাত।।
মাকড়া পাথর জুরে কোন কারিগর।
গড়ে গেছে কাহিনী টিলার উপর। ।
স্বর্গে গিয়ে নিজের বোকামির জন্য ভগবানের কাছে বকুনি খেলেন। এরপরে তিনি কোনো ঝুকি না নিয়ে সমুদ্রের নীচে বসে তৈরী করেছিলেন পুরীর মন্দির। মন্দির নির্মাণ শেষ হলে সমুদ্রের জল সরে যায় এবং পুরীর মন্দির জেগে উঠে। দেউলবাড়ের অসমাপ্ত মন্দিরটি বিগ্রহহীন অবস্থায় পড়ে থাকে। রামচন্দ্র যখন সীতাকে দ্বিতীয়বার বনবাসে পাঠালেন, তখন সীতা এখানে এসে তপোবনে বাল্মীকির আশ্রমে ছিলেন। এই তপোবনেই লব ও কুশের জন্ম হয়েছিল। তিনি প্রতিদিন লবকুশকে তেল হলুদ মাখিয়ে একটি ঝণর্ণার জলে স্নান করতেন বলে সেই ঝর্ণার জল হলুদ হয়ে গেছে। তপোবনে একটি অর্ধ-চেরা শাল গাছ "সীতা দাঁতন" নামে পরিচিত। তপোবনে আছে একটি অনির্বাণ যঞ্জকুন্ড। প্রথা আছে, এই স্থান দিয়ে কেউ গেলে এক খন্ড কাঠ যঞ্জকুন্ড দিয়ে যেতে হয়। বনবাসে এসে বনের সৌন্দর্যে মুগ্ধ সীতা স্বামী রামচন্দ্রের মঙ্গল কামনায় বিশ্বকর্মা নির্মিত অসমাপ্ত মন্দিরে শিবকে প্রকট হতে অনুরোধ করেন। সতী সাবিত্রী সীতার প্রার্থনায় শিব সেই অসমাপ্ত মন্দিরে দ্বাদশ লিঙ্গ রূপে প্রকট হলেন। সীতা প্রতিদিন স্বামী রামচন্দ্রের মঙ্গল কামনায় রামের ইষ্টদেবতা এই দ্বাদশ লিঙ্গ শিবকে পূজো করতেন বলে এর নাম রামেশ্বর শিব।
মন্দির থেকে সুবর্ণরেখার বুকে।
নেমে গেছে সারিবদ্ধ পাথর সোপান। ।
এই শিব স্থাপন করে সীতা।
পূজ্য পাঠ বন্দনা - এখন জনশ্রূতি।।
মন্দিরের গর্ভগৃহ, জগমোহন, ভোগমন্ডপ এবং নাটমন্দিরের নিচু প্রবেশদ্বার চারটি, সমান্তরাল ভাবে এক সরলরেখায় এমন ভাবে নির্মিত যাতে প্রভাতে সূর্যের আলো মন্দিরের গর্ভগৃহে সোজাসুজি প্রবেশ করতে পারে। মন্দিরের গর্ভগৃহে দ্বাদশ লিঙ্গ শিবের অবস্থান। গৌরীপীঠের অভ্যন্তরে কেবল শিব লিঙ্গের মাথাটি দেখা যায়। মূল লিঙ্গের উপরিতলে এগারোটি ছোট ছোট লিঙ্গ, কেন্দ্রে অবস্থিত একটি লিঙ্গকে বেষ্টন করে আছে।
মন্দিরের পিছনের দিকে ১০৮ টি পাথরের সিড়ি ধাপে ধাপে নেমে এসে শেষ হয়েছে একটি কুন্ডের পাশে। এটি কুন্ড পুকুর নামে পরিচিত। এই কুন্ডে সারা বছর জল থাকে। কুন্ডের গা ঘেঁষে একটি খাল বয়ে গিয়ে সুবর্ণরেখা নদীতে পড়েছে।
রামেশ্বরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে আমাবস্যার অন্ধকার রাতে এখানে টিলার নীচে নদীর তীরে মেলা বসে মাঘ মাসে শিবরাত্রি উপলক্ষে । এটা কম আশ্চর্যের নয়। এখানে এসে শিবের ব্রতচারিনীরা মন্দির চত্বরে প্রদীপ জ্বেলে রাত জাগেন। তাছাড়া অন্য মেলার মতোই হরেক দ্রব্যের দোকানে মেলা বিশাল আকার ধারণ করে। মেলাটির অন্যতম আকর্ষণ হল অ-আদিবাসীদের সঙ্গে আদিবাসী পুরুষ ও রমণীর বিপুল সংখ্যায় অংশগ্রহন। সারা রাত্রি ব্যাপী মেলায় আদিবাসী নৃত্য-গীত এবং সাঁওতালী যাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। নয়াগ্রাম এলাকায় অন্য কোনো বড় মেলা না থাকায় সকল শ্রেণীর মানুষ যে এই মেলায় এক রাত্রির আনন্দের জন্য আসে, সে কথা নি:সংশয়ে বলা যায়। রামেশ্বরের শিবরাত্রীর মেলাটি এই এলাকার সাংস্কৃতিক মিলন-মিশ্রন ও সহাবস্থানের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
সড়কপথে কলকাতা থেকে NH 6 ( মুম্বাই-কলকাতা মহাসড়ক ) ধরে ঝাড়গ্রামে পৌচ্ছাতে সময় লাগে প্রায় চার ঘন্টা। ঝাড়গ্রাম থেকে গোপীবল্লভপুর ৪২ কিমি। গোপীবল্লভপুর থেকে জঙ্গলের পথ ধরে ২৩ কিমি এগোলেই দেউলবাড়ের রামেশ্বর শিব মন্দির।
এছাড়া হাওড়া থেকে খড়্গপুর স্টেশনে পৌচ্ছাতে এক্সপ্রেস/ লোকাল ট্রেন আছে। সময় লাগে প্রায় ২ ঘন্টা ২৪ মিনিট। এখান থেকে সহজেই ঝাড়গ্রাম আসা যায়।
No comments:
Post a Comment