সতীপীঠ...... নলাটেশ্বরী মাতা মন্দির ..
.... নলহাটি ...... বীরভূম....
রাঢ় বাংলার লাল রুক্ষভূমি বীরভূম। বীরভূমের অউল-বাউল-ফকির-পীর-দরবেশ-সাধু-সন্ত-সাধক ও পঞ্চপীঠ খ্যাত অতীতের নলহাটি কালিন্দীপুর গ্রাম নিয়ে আজকের পৌর শহর নলহাটি। এই ভূ-খন্ডে রয়েছে ছোটনাগপুরের মালভূমির গন্ধ। পঞ্চপীঠ খ্যাত এই জেলার উত্তরে অবস্থান করছেন নলহাটিতে সতীপীঠ দেবীপীঠ মা নলাটেশ্বরী। সতীর নলা পরেছে বলেই এখানকার নাম নলহাটি। দেবীকে কেউ বলে কালিকা, কেউ বলে দেবী পার্বতী। মন্দির গাত্রে রয়েছে গুপ্ত স্থাপত্যের নিদর্শন, চার চালা মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রস্তর খন্ডে
মহাদেবীর কালিকারূপী " মা নলাটেশ্বরী "। একান্নটি সতীপীঠেই স্বয়ং মহাদেবী ভগবতীর নানা রূপে অধিস্্ঠতা। এখানে প্রতিষ্ঠিত দেবীর নাম শেফালিকা ও এখনের ভৈরব হলেন যোগীশ। স্থানীয় লোকেরা মাকে ললাটেশ্বরী বলে ডাকে। স্থানীয় অনেকই জানেন না এটি সতীপীঠের একটি।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মধ্যে মা নলাটেশ্বরীর মন্দির। চার চালা মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রস্তর খন্ডে মহাদেবীর কালিকারূপী " মা নলাটেশ্বরী "। একান্নটি সতীপীঠেই স্বয়ং মহাদেবী ভগবতী নানা রূপে অধিষ্ঠিতা। নলহাটিতে প্রস্তর খন্ডে কালিকা রূপী মহাদেবীর মূর্তি, সিন্দুর চর্চিত মুখমন্ডল, মাথায় চাঁদির ছাতা, সুদীর্ঘ ভ্রু, ত্রিনেত্র, বিকাশিত দন্ত, নাক, চিক্কন ললাট, এলোকেশী কালিকারূপী সতীমা তথা দেবী ভগবতী। মুখের নীচেই রয়েছে মহাসতীর কন্ঠনলী। নলীতে যতই জল ঢালা হোক না কেন জল কখনই উপচে পড়ে না। আবার দীর্ঘক্ষণ জল না ঢাললেও নলীতে জল একই জায়গায় রয়। এ কেবল সকালে স্নানের সময় দেখা যায়। জল ঢালার সময় ঢোক গেলার আওয়াজ হয়। চোখের পাতা নেই। অশুভ শক্তি বিনাশ করার জন্য সদা জাগ্রত। ঘন জঙ্গলের ভেতর একটি অদ্ভুত ধরনের প্রাচীন বট গাছের নীচে মায়ের আবির্ভাব। এখানে দেহের আরাম , মনের শান্তি, কামনা-বাসনা খুঁজে পাওয়া যায়।
পুরান আখ্যান এবং পীঠ নির্নয় গ্রন্থ থেকে জানা যায় প্রজাপতি দক্ষের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহামায়া দক্ষপত্নী অসিক্লীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন সতী। সতী ছোটবেলা থেকে মহাদেব শিবকে পতীরূপে গ্রহন করেন। ব্রহ্মার মধ্যস্থতায় সতী ও শিবের বিবাহ হয়। বিবাহের কিছুকাল পরে নৈমিষারণ্যের এক যঞ্জসভায় দক্ষ উপস্থিত হলে শিব তাকে উপযুক্ত সন্মান না দিলে দক্ষ অপমানিত বোধ করেন। অপমানিত দক্ষ নিজ বাড়িতেই মহাযঞ্জের আয়োজন করেন এবং শিবকে নেমতন্ন করেন না। শিবের বারংবার নিষেধ সত্ত্বেও সতী বিনা নিমনন্ত্রে পিতা আয়োজিত যঞ্জস্থলে যান। সতীর দশ রূপ দেখে শিব মৌন থাকেন। দক্ষ সতীকে লক্ষ্য করে যঞ্জস্থলে শিব নিন্দা করতে থাকেন। পতিনিন্দা সহ্য করতে না পেরে যঞ্জাগ্নিতে আত্মাহুতি দেন। ফল হয় ভয়ংকর। শিব রূদ্রমূর্তি ধারণ করে দক্ষের যঞ্জ লন্ড ভন্ড করে দেন। শিবের অন্যতম চর দক্ষের মুন্ড ছেদ করেন। শিব রাগে দু:খে হিতাহিত ঞ্জান শূন্য হয়ে সতীর প্রানহীন দেহ কাধে তুলে তান্ডব নৃত্য শুরু করেন। সৃষ্টি বিলুপ্ত হওয়ার মত অবস্থা হয়। সৃষ্টি কর্তা ব্রহ্মা এবং পালন কর্তা বিষ্ণু কৌশলে শিবকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্রের দ্বারা সতীর দেহ খন্ড বিখন্ড করে দেয়। সতীর এই দেহ খন্ড একান্নটি স্থানে পড়ে একান্নটি সতীপীঠের সৃষ্টি হয়েছে। পীঠ অর্থ আসন বা স্থান।
অন্যমতে ১৪০০ বৎসর আগে স্বপ্নাদেশ পেয়ে অগেকার পাটলিপুত্র থেকে এসে গৃহী সাধক রামশরণ শর্মা সতীমায়ের কন্ঠনলী আবিষ্কার করেন। পূজা অর্চনা শুরু করেন। যাগ যঞ্জ করে সতীমাকে জাগ্রত করেন। করেন নিত্য পূজার ব্যবস্থা। তিনি ছিলেন নি:সন্তান। দেবী তাকে বর দিতে চান। তিনি সন্তান কামনা করেন। মহাদেবী ভগবতী তাকে বর দেন " দুটি সন্তানের জন্ম হবে। তবে একটি সন্তান মাকে উৎসর্গ করতে হবে।" যথা দুুুটি সন্তান হয়। কামদেব ও বামদেব। কামদেব উৎসর্গিত হয়ে এখানে এসে নিয়মিত মায়ের পুুুুজা অর্চনা শুরু করেন। সেই থেকে দেবীর জনমানসে প্রচার শুরু হয় ।
প্রথম অন্নভোগ নিবেদন করেন আষাঢ় নবমীতে কাশী থেকে এসে ব্রহ্মচারী কুশলানন্দ। আগে তারাপীঠ, পরে ১২৯৬ সালে এখানে এসে মায়ের চরণের কাছে পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে সিদ্ধিলাভ করেন। মন্দিরের উত্তরে রয়েছে তাঁর সিদ্ধাসন। আর রয়েছে পাহাড়, খোদাই করা 8 ফুটের গনেশ মূর্তি , মা ষষ্ঠী- নীম গাছের নীচে। মূল মন্দির নির্মাণ করেন নাটোরের রাণীভবানী। অদূরে রয়েছে " যোগেশ ভৈরব"। ভৈরবের দেওয়ালে আপনা থেকেই উদ্ভব হয় " শ্রী বিষ্ণুর চরণ যুগল "। এই ঘটনাকে অনেকেই দৈবভাব মনে করে। শাক্ত ও দৈবভাব এখানে উপস্থিত। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় অনুশীলন সমিতির সদস্য নগেন বাগচী বেশ কিছুদিন এখানে আত্মাগোপন করে মায়ের সেবা কর্ম করেন। পরে পুলিশ তাড়া করলে তারাপীঠে বামাক্ষ্যাপার কাছে চলে যান। দৈব আর এক ঘটনা -------- এই টিলা পাহাড়ে একটি নিম গাছ ছিল ---- তার পাতা পেরে খেলে মিষ্টি কিন্ত পাতাটি মাটি স্পর্শ করলে ভীষণ তেতো। মন্দিরের অদূরে ব্রাহ্মণী নদী। অরণ্য ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা।
এখানে আসা-যাওয়ার জন্য হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে সবসময় ট্রেন যোগাযোগ রুয়েছে। জাতীয় সড়ক ধরে বাস যোগাযোগ তো আছেই। বর্গীসর্দার ভাস্কর পন্ডিত এই পাহাড়ের সমতল অংশে নিয়মিত ভাবে কিছুকাল ছিলেন। তাই পাহাড়ের এক নির্দিষ্ট অংশের নাম "বর্গীডাঙ্গা"। ইতিহাসের সাথে মিশে রয়েছে মন্দিরের গাম্ভীর্য আর কাহিনী। এছাড়াও রয়েছে নলাটেশ্বরী মাতা মন্দিরের পিছনে টিলা পাহাড়ে বনবাসকালে রামসীতার বিশ্রাম স্থলের বিভিন্ন নিদর্শন সহ রামসীতার মন্দির। আর পাশেই রয়েছে ইসলাম ধর্মের বাবার ঈদগা ও মাজার।
বেলা ১টায় অন্নভোগ নিবেদন এবং সন্ধায় সন্ধারতি হয়। আজও এখনে পাঠা বলিদান প্রথা চালু আছে। রীঁ নলাটেশ্বরী মাতার পূজার প্রধান উপকরন --- চাঁছি সন্দেশ ও পেড়া সন্দেশ। প্রত্যহ সূর্যোদয়ের পর মাতার স্নান ও কন্ঠনলী পরিস্কার সহ বিভিন্ন উপকরনে সাজানো হয়, তৎপরে মঙ্গল আরতি এবং পূজাপাঠ শুরু হয়। ঐ সময় উপস্থিত থাকলে দর্শন হয়। প্রত্যহ সকাল ৫-৩০মি থেকে রাত্রি ৮টা পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে। তারপরে মাতার শয়ণ। ঋতু হিসেব সময়ের পরিবর্তন হয়। বর্তমান মন্দিরে আধুনিকতার ছাপ লেগেছে। তৈরী হয়েছে লজ এবং নানাবিধ পরিষেবার ব্যবস্থা।
No comments:
Post a Comment