Thursday, 16 May 2019

দেবী জগধাত্রী, ‌ দূর্গা দেবীর অপর রূপ।

দেবী জগদ্ধাত্রী , দূর্গা দেবীর অপর রূপ। উপনিষদে এর নাম উমা হৈমবতী। হিন্দু বাঙালির ধর্মীয় মানসে রাজসিক দেবী দুর্গা ও তামসিক দেবী কালীর পরেই স্থান সত্ত্বগুনের দেবী জগদ্ধাত্রীর। জগদ্ধাত্রী শব্দের আভিধানিক অর্থ ... জগৎ + ধাত্রী। জগতের ( তিন ভুবনের ) ধাত্রী (ধারনকর্তী, পালিকা।

পুরান মতে মহিষাশুর বধের পর দেবতারা উল্লাসে মেতে উঠেছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন , দূর্গা যেহেতু তাঁদেরই সন্মিলিত শক্তির প্রকাশ, তাই অসুরের বধ হয়েছে তাঁদেরই যুগ্ম শক্তিতে। ব্রহ্মার বরের সন্মান রক্ষা করতে কেবল ওই নারীদেহটির আবশ্যিকতা। তাঁদের ওই গর্ব দেখে পরমেশরী দেবী একটি তৃণখন্ড অলখ্য থেকে ছুড়লেন দেবতার দিকে। পরীক্ষা করতে চাইলেন তাঁদের শক্তি। ইন্দ্র বজ্র দ্বারা সেই তৃন ধ্বংস করতে ব্যর্থ হলেন। অগ্নি সেই তৃন দহন করতে পারলেন না। বায়ু অসমর্থ হলেন তা উড়িয়ে নিয়ে  যেতে। বরুনের শক্তি সেই তৃনটুকুর একটি অংশও জলস্রোতে প্লাবিত করতে পারল না। দেবতাদের এই অবস্থা দেখে তাঁদের সামনে আবির্ভূতা হলেন এক পরমাসুনদরী সালাঙকারা চতুর্ভুজা মূর্তি। তিনিই জগদ্ধাত্রী। জগদ্ধাত্রী এভাবে আবির্ভূতা হয়ে দেবতাদের বুঝিয়ে দিলেন.... তিনিই এই জগতের ধারনী শক্তি।

দেবী জগদ্ধাত্রীর পূজা অনুষ্ঠিত হয় দূর্গা পূজার ঠিক এক মাস পর কার্তিক মাসের শুক্লা নবমীতে। জগদ্ধাত্রী পূজা তান্ত্রিক পূজা। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী এই তিন দিন দেবীর পূজা হয়ে থাকে।

জগদ্ধাত্রী দেবী ত্রিনয়না, চতুর্ভুজা ও সিংহবাহিনী। তাঁর হাতে শঙ্খ, চক্র, ধনুক ও বান। গলায় নাগযজোগ উপবীত। প্রতিমার বাহন সিংহের পদতলে একটি হস্তীমুন্ড থাকে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে দেবী করীন্দাসুর অর্থাৎ মহাহস্তী রূপী অসুরকে বধ করেছিলেন। এই কারনে দেবী জগদ্ধাত্রী করীন্দাসুরনিসূদিনী নামে পরিচিত।

জগদ্ধাত্রী পূজা বাঙালি হিন্দু সমাজের একটি বিশিষ্ট উৎসব হলেও , দূর্গা বা কালী পূজার তুলনায় এই পূজার প্রচলন অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে ঘটে। অষ্টাদশ শতকে নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় তাঁর রাজধানী কৃষ্ণনগরে এই পূজো প্রচলন করার পর এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।

কিংবদন্তি অনুসারে নবাব আলিবর্দীর রাজত্ব কালে মহাবদজঙগ্ রাজার নিকট থেকে বারো লক্ষ টাকা নজরানা দাবি করে। নজরানা দিতে অপারগ হলে তিনি রাজাকে বন্দী করে মুর্শিদাবাদ নিয়ে যান। মুক্তির পর নদী পথে কৃষ্ণনগরে প্রত্যাবর্তনের সময় ঘাটে বিজয়া দশমীর বাজনা শুনে তিনি বুঝতে পারেন সেই বছর দূর্গা পূজার কাল উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। দূর্গা পূজার আয়োজন না করতে পেরে রাজা অত্যন্ত দুঃখিত হন। সেই রাতে দূর্গা জগদ্ধাত্রী রূপে রাজাকে সপ্নে পরবর্তী শুক্লা নবমী তিথিতে জগদ্ধাত্রী পুজো করার আদেশ দেন। রাজবাড়ীর জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা হয় ১৭৬৬ সালে। আর এই কৃষ্ণনগর রাজবাড়ীর পূজো দেখে মুগ্ধ হয়ে ইন্দ্র নারায়ন চন্দননগরের লক্ষ্মী গঞ্জে চাউল পট্টিতে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেন। এই পূজো চন্দননগরে আদি পূজো নামে পরিচিত।

তারকেশ্বরের চক্রবর্তী পরিবারের বহু প্রাচীন এই জগদ্ধাত্রী পুজো। আগে ঘটে পটে পূজো হলেও এখন মূর্তি করে দেবীর আরাধনা করা হয়। নীচে এবারের পূজোর কিছু ছবি।












নন্দদিরঘি বৌদ্ধ বিহার, জগজীবনপুর, মালদা।

নন্দদিরঘি বৌদ্ধ বিহার, জগজীবনপুর, মালদা

মালদা জেলার হাবিবপুর ব্লকের ছোট্ট এক গ্রাম জগজীবনপুর।  কিছু কাল আগেও এটি  অচেনা নিতান্ত বাঙলার গ্রাম হিসাবে পরিচিত ছিল। কিছু দিন আগে এক চাষী তার চাষের কাজের জন্য মাটি খুঁড়ছিল। কোদালে এক শক্ত জিনিস আটকে যায় এবং বেরিয়ে আসে এক তাম্রলিপি। তাম্রলিপির উপরে ছিল রাজকীয় সিলমোহর। তার উপরে ছিল প্রস্ফুটিত পদ্মের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মচক্র , মাথায় ছত্র আর দুপাশে দুটি হরিণ। এগুলি সবগুলোই হল পাল বংশের প্রতিক। খবর পেয়ে আর্কিওলজিক‍্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া সেই ঢিবিতে খনন কার্য চালায়। তখনি প্রকাশ‍্যএ আসে বহু ইতিহাসের সাক্ষী সেই  " নন্দদিরঘি বৌদ্ধবিহার "।

তাম্রলিপিটি লম্বায় ৫২ সে মি, প্রস্তে ৩৭.৫ সে মি, পুরু ০.৫ সে মি আর ওজন ১১ কিলো ৮০০ গ্রাম। ফলকটির একদিকে সিদ্ধমাতৃকা লিপিতে খোদাই ছিল ৪০ লাইন, অন্য দিকে ৩৩ লাইন। প্রতিটি লাইনে ছিল ৫০ টি অক্ষর। নীচে লেখা " শ্রী মহেন্দ্র পাল দেব "। গবেষকদের মতে রাজা মহেন্দ্র পাল দেব মহাবিহার নির্মাণের জন্য এই জমি দান করেছিলেন। যে মহাবিহার পরে " নন্দদিরঘি বৌদ্ধমহাবিহার " নামে গোটা পৃথিবীতে পরিচিত হয়। তাঁরা আরও বলেন , এই মহাবিহার নালন্দা মহাবিহার থেকেও পুরনো ও বড়। এর পাশেই রয়েছে পুনরভবা নদী। নদীর ওপারে বাঙলাদেশের দ্বারপালেও এই বিহারের একটি অংশ মাটির নীচ থেকে উঠে এসেছে। অর্থাৎ এই বিহারটি প্রায় ৩ কি মি ব্যাসার্ধ নিয়ে তৈরি। তার সামান্য অংশই খনন হয়েছে। এখনও মাটির নিচে পড়ে রয়েছে আরও অনেক অজানা ইতিহাস।

২০১১ সালে রাজ‍্যসরকারের পালা বদলের পরে ২০১৪ সালে তৎকালীন পর্যটন মন্ত্রীর উদ্যোগে ঐ বৌদ্ধ বিহারে যায় আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ সঙগঠনের এক প্রতিনিধি দল। সেখানে মন্ত্রী মহাশয় জানান জগজীবনপুরকে জেলার পর্যটন মানচিত্রে স্থান দিয়েছে রাজ‍্যসরকার। সেখানে আধুনিক পর্যটনের সমস্ত পরিকাঠামো নির্মাণ করা হবে।

মালদা ইংরেজ বাজার থেকে প্রায় ৪১ কি মি  দূরে। মালদা থেকে প্রথমে নালাগোলা এবং তারপর নালাগোলা থেকে পাকুয়াহাট হয়ে কেন্দ্পূকুর। সেখান থেকে জগজীবনপুর। এছাড়া পাকুয়াহাট থেকে -- খিড়িপাড়া -- ১১ মাইল-- তপসাহার -- ডাললবাহাদুরপুর -- বাকাইল  হয়েও আসা যেতে পারে জগজীবনপুর।

এখন অনেকই চাইছেন, নন্দদিরঘি বৌদ্ধ মহাবিহারকে পুরোদস্তুর সাজিয়ে তুলুক সরকার। প্রতি সন্ধ্যায় গুরুগম্ভীর সুরে উচ্চারিত হোক  " বুদ্ধুঙ শরনঙ গচছামি, ধর্মঙ শরনঙ গচছামি, সঙঘঙ শরনঙ গচছামি " । আর সেই সুর অনুরণিত হোক এলাকাজুড়ে।















Wednesday, 15 May 2019

পল্লী কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিক, কোগ্রাম।

"বাড়ি আমার ভাঙ্গনধরা অজয় নদীর বাঁকে,
জল সেখানে সোহাগ ভরে স্থলকে ঘিরে রাখে"

বর্ধমানে পুরনো জি টি রোডের মোড়ে নবাবহাট। এখানে আছে ১৭৮৮-১৭৯০ সালে তৈরি ১০৮+১=১০৯ শিব মন্দির। রুদ্রাখের মালার মত। একই মাপের। একই রঙের। এখান থেকে শান্তিনিকেতন ৫২ কি মি দূরে। অবনসেতু হয়ে পথ গিয়েছে সোজা শান্তিনিকেতন। তার আগে গুসকরা। মঙ্গলকোটের নতুনহাটের মোড় থেকে বাঁ দিকে গুসকরার পথে কিছুটা গিয়ে কুনুরের উপর কুমুদ সেতু পার হয়ে ডান দিকে পথ গিয়েছে কোগ্রামে। পল্লীকবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের জন্মভিটে।

কুমুদরঞ্জনের আমবাগানকে বাঁয়ে রেখে পথ চলা।দুদিক অজয় আর কুনুর এগিয়ে আসছে। ছোট্ট কুনুর কোগ্রামকে দখিন ও পুব দিকে বেড় দিয়ে অজয়ের মিশেছে। অজয় এখানে উত্তর বাহিনী। অজয়ের এ পারে বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট, ওপারে বীরভূমের নানুর। মঙ্গলকাব্যের উজানী নগর আজকের কোগ্রাম। পল্লীকবি কুমুদ রঞ্জনের কোগা।

চৈতন্য মঙ্গলের কবি লোচনদাসের শ্রী পাট ছিল কোগ্রামেই। অল্প বয়সে বিয়ে করেও লোচনদাস বিদ‍্যআভ‍্যআস করে যান। ভুলে যান সংসার ,  যৌন জীবন। স্ত্রী ক্রুদ্ধ হয়ে গাঁয়ের নাম দেন কুগ্রাম। লোচনদাস তাকে কোগ্রাম করেন। এখন কোগা। অজয়ের ধারে লোচনদাসের সমাধি। কাছেই সর্বমঙ্গলা মন্দির। আর এক সতীপীঠ। কুনুর নদী ঝাঁপিয়ে পড়েছে গেরুয়া-বসন-উদাসীন-সনন‍্যআসী সম অজয়ের বুকে।

















শ্যামরূপা মায়ের মন্দির, দূর্গাপুর।

গড়ের জঙ্গলে শ্যামরূপা মায়ের মন্দির।


দূর্গাপুর শহর থেকে প্রায় ১৫  কি মি দূরে এক গহন গভীর জঙ্গলে প্রকৃতির কোলে ১০০০  বছরের পুরনো একদেবী মূর্তির পূজো হয় মহা সমারোহে। বর্ধমান জেলার অন্তর্গত অজয় নদীর তীরে বিষ্ণুপুর ও খেড়োবাড়ির মাঝামাঝি এই শ্যামরূপা গড়, সুখ্যগড় বা ঢেকুর গড়। দুর্ভেদ্য জঙ্গল। গড়ের জঙ্গলের বিশেষত্ব হল অলৌকিক তোপধ্বনি। দুর্গাপূজার অষ্টমীর সন্ধি পূজোতে তোপের আওয়াজ আর সেই আওয়াজ কোথা থেকে যে আসে, কি তার উৎস, কবে এর শুরূ , কি তার বৈজ্ঞানিক সত্যতা ...... তা কেউ জানে না। তাই তোপের আওয়াজ শুনতে আজও কাঁকসার গড় জঙ্গলের শ্যামরূপা মন্দিরের পূজোতে ভিড় জমান‌ হাজার হাজার মানুষ। তোপের আওয়াজের পরেই পাঁঠা বলি শুরু হয়। অষ্টমীর দিনে এখনো শাদা পাঁঠা বলি হয় এখানে। মানুষের  সামলাতে পূজোর এই চার দিন প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয় এখানে।

মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত প্রস্তর নির্মিত সুদর্শনা দূর্গা মূর্তি। উচ্চতায় প্রায় দশ বারো ইঞ্চি। মন্দির প্রাঙ্গণে রয়েছে একটি হাড়িকাঠ। কথিত আছে এই জঙ্গলে এক সময় ছিল কাপালিকদের বাস। তারা রীতিমতো পূজো করতে দিতেন নরবলি। একবার অজয়নদের ওপারে অবস্থিত কেন্দুলি গ্রাম থেকে  " গীতগোবিন্দ " এর রচয়িতা কবি জয়দেব আসেন এই মন্দিরে। তিনি কাপালিককে প্রস্তাব দেন যদি তিনি তাকে চাক্ষুস মাতৃ দর্শন করাতে পারেন তবেই প্রমাণ হবে যে নরবলি দেবী গ্রহন করেন। যদি কাপালিক তা না পারেন তাহলে কবি তাঁকে শ্রীকৃষ্ণ বা শ্যাম রূপ দর্শন করাবেন। তবে তাতে শর্ত একটাই ... নরবলি বন্ধ করতে হবে। কবির এই প্রস্তাবে রাজি হলেন কাপালিক। চেষ্টা করলেন তাঁর উপাস্য দেবীকে দেখতে। ব্যার্থ হলেন। এরপর জয়দেবের ভক্তিপূর্ন আকূল প্রার্থনায় শ্যামামা শ্যাম রূপ ধারণ করে দর্শন দিলেন কাপালিককে। আনন্দ আবেগে কাপালিক লুটিয়ে পড়লেন কবি জয়দেবের চরনতলে। সেই থেকে মন্দিরে পূজিত দেবীর নাম হয় " শ্যামরূপা" দূর্গা আর বন্ধ হয় নরবলি।

এখানে মন্দিরে প্রতিদিন নিত্য সেবা হয়। মন্দিরের দুজন পূরোহিত, ভূতনাথ রায় ও দিলীপ রায় , প্রতিদিন বিষ্ণুপুর গ্রাম থেকে দু মাইল পথ অতিক্রম করে মায়ের পূজা অর্চনা করেন। প্রতিদিন মায়ের ভোগ প্রসাদ পাওয়া যায়। ভোগ প্রসাদ পেতে হলে আগেরদিন এই মোবাইল নং এ যোগাযোগ করতে হবে --৯৪৩৪৩৪৫১০৫ বা ৯৪৭৫৭৪৫৫৮৮ । দুর্গাপূজা, বাসন্তী পূজা, অক্ষয় তৃতীয়া, জন্মাষ্টমী ও বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন পূজো হয় এখানে। এছাড়া বিবাহ ও বনভোজন তো চলেই।

পিচরাস্তা থেকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মোরামের রাস্তা ধরে শ্যামরূপা মন্দিরে যাওয়ার রাস্তার অবস্থা জরাজীর্ণ। বর্ষাকালে রাস্তা জলে ভরে যায়। তবে বর্তমান সরকারের উদ্যোগে গভীর জঙ্গলে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে। যার ফলে স্থানীয়দের মুখে কিছুটা হাসি ফুটেছে।

দুর্গাপুর ষ্টেশন বা জি টি রোডের উপর মুচিপাড়া স্টপেজ থেকে গাড়ি ভাড়া নিয়ে মালানদিঘী যেতে হবে। সেখান থেকে ২ কি মি যাওয়ার পর দেখা যাবে " দেউল / শ্যামরূপা মন্দির " সাইনবোর্ড। সেখান থেকে পূর্ব দিকে প্রায় ৩  কি মি এগিয়ে গেলে মন্দির।

এছাড়া দার্জিলিং মোড় থেকে ১১- মাইল হয়ে  পশ্চিমে গেলে দেউলে পৌঁছে যাওয়া যায়। সেখান থেকে পথ নির্দেশ অনুযায়ী মন্দিরে যাওয়া যায়। এপথে‌ মন্দির দূরত্ব কমবেশি ১০ কি মি।